চমকে উঠে বললাম, কৈ ভূত?
তুমি যাকে মন দিয়ে দেখছ।
হেসে ফেললাম। ছেঁড়া কালো তারটা কি ভূতেরই ছদ্মবেশ?
সম্ভবত। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ভূতেরা বহুরূপী। ইচ্ছে করলেই যে কোনও রূপ ধরতে পারে। বিশেষ করে কালো রঙ ভূতেদের খুব পছন্দ। কারণ তারা অন্ধকারের প্রাণী।
একটা ছেঁড়া কালো তার নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। কর্নেলের কৌতুকে কান দিলাম না। বললাম, বাড়িতে মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না। এত অযত্নের ছাপ কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললনে, আগের বার এসে বসকিছু ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন এবং সাজানোগোছানো দেখেছিলাম। এবার দেখছি অন্যরকম। এর কারণ হয়তো ভূত তার মানে, রায়সায়েবের বাড়িকে ভূতে ধরেছে।
বেচু ট্রেতে কফির পেয়ালা সাজিয়ে ঘরে ঢুকছিল। কর্নেলের কথা শুনে বলল, যা বলেছেন স্যার! কতবার কর্তামশাইকে বলেছি, ওঝা ডেকে এর বিহিত করুন। কিংবা বামুন ডেকে শান্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করুন। কর্তামশাই কান করছেন না। নিচের ওই কোণার ঘরটাতে একা থাকি। ওঁরা তো ওপরতলায় থাকেন। সারা রাত ঘুমুতে পারিনে। আর কিছুদিন দেখেই আমি কেটে পড়ব স্যার।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি ভূতের মন্ত্র জানি। দেখ না, আজ রাতেই ভূত জব্দ করে ফেলব।
বেচু হাসল। কিন্তু আগে কালো বেড়ালটাকে জব্দ করা দরকার স্যার!
করব। তুমি ততক্ষণ এক কাজ করো। এখনই হরনাথবাবুর বাড়ি গিয়ে তোমার কর্তামশাইকে খবর দাও। আমাকে একবার বেরুতে হবে। রায়সায়েবের সঙ্গে দেখা না করে বেরুতে পারছি না।
বেচু বলল, গেটের দিকে একটু নজর রাখবেন যেন। আমি খবর দিয়ে আসি।
সে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে। কর্নেল বললেন, গেটের দিকে নজর তুমিই রাখো অন্ত। কাকেও আসতে দেখলে আমাকে ডাকবে।
উনি উঠে দাঁড়ালে বললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ওপরে গিয়ে বাইনোকুলারে বাড়ির চারপাশটা একবার দেখে নিই।
কিন্তু কফি পড়ে রইল যে।
থাক, এখনই আসছি।
কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উধাও হয়ে গেলেন। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। রক্তখেকো কালো বেড়ালটা এসে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর? এমন একটা পোভড়া বাড়ির মতো পরিবেশে সবই সম্ভব।
কর্নেলের ফিরতে দেরি হচ্ছিল। আমার অস্বস্তিটাও তত বেড়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ পরে কর্নেল নেমে এলেন। বললাম, কালো বেড়ালটাকে দেখতে পেলেন নাকি?
নাহ্। তবে দুটো ভূত আমি পকেটে পুরে এনেছি।
তার মানে?
কর্নেল সকৌতুকে প্যান্টের একটা পকেটে হাতের চাপ দিয়ে বললনে, মন্ত্রপূত রুমালের ভেতর দু-দুটো ভূত জব্দ হয়ে চুপ করে আছে। বলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন।
বললাম, হেঁয়ালি না করে বলবেন কি?
কর্নেল বললেন, চুপ! ওই দেখ, কালো বেড়ালটা আবার পাঁচিলে উঠেছে।
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, পাঁচিলের ওপর ঝুঁকেপড়া গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে কালো বেড়ালটা আবার গুটিসুটি হেঁটে আসছে। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন। বললেন, ওর লক্ষ্য হলো কিচেন। অবশ্য বেড়াল মাত্রেরই লক্ষ্য হলো কিচেন। চুপচাপ বসে থাকো। দেখা যাক, ও কী করে।
কিছুক্ষণ পরেই পাশের কোনও ঘরে থালা-বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ হলো। নিঝুম নিরিবিলি বাড়িতে শব্দটা চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কর্নেল উঠে গিয়ে একটা ঘরের পর্দা তুললেন। ওই ঘর থেকেই বেচুকে কফি আনতে দেখেছিলাম।
কর্নেলকে বলতে শুনলাম, না, না! ভয় কোরো না। কী খুঁজছ, বুঝতে পেরেছি। এক মিনিট।
উনি ঘরে ঢুকে গেলে ব্যাপারটা দেখার জন্য উঠে পড়লাম। পর্দা তুলে দেখি, কর্নেল ফ্রিজ খুলে একটা ছোট্ট বোতল বের করছেন। বেড়ালটা জানালার গরাদের ফাঁকে বসে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। কর্নেল বোতলের ছিপি খুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর কিছু ঢালছিলেন। বললাম, কী খেতে দিচ্ছেন ওকে?
টমাটো সস। বলে কর্নেল ফ্রিজে বোতলটা ঢুকিয়ে রাখলেন। মুচকি হেসে বললেন, চলল! শ্রীমান কালো ভূত খাওয়াদাওয়া করুক। সামনে থাকলে লজ্জা পাবে।
হলঘরে ফিরে এসে সোফায় বসে বললাম, বেড়াল টমাটো সস খায় কস্মিনকালে শুনিনি। তাছাড়া আপনি কেমন করে জানলেন ও টমাটো সস খুঁজছে?
ডাইনিং টেবিলের এঁটো থালায় টমাটো সসের চিহ্ন দেখলাম। চাটতে গিয়েই থালাটা নিচে পড়েছে। আবার থাবায় থালাটা আঁকড়ে ধরে চাটতে যাচ্ছে, সেই সময় আমি গিয়ে পড়েছি। দেখামাত্র বুঝলাম টমাটো সস ওর প্রিয়।
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! তা হলে সে রাত্রে এই কার্পেটের ওপর–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, টমাটো সসই খাচ্ছিল। রাত্রিবেলা দেখলে রক্ত চাটছে বলে ভুল হতেই পারে। তাতে বেড়ালটার রঙ কালো এবং সে-রাত্রে একটু আগেই ভুতের উৎপাত যখন শোনা গেছে।
তাহলে কার্পেট ধুয়ে সাফ করার সময় বেচুর সেটা টের পাওয়া উচিত ছিল।
ছিল বৈকি।
কিন্তু বেচু এখনও বলছে রক্ত।
ভূত ওকে বলতে বাধ্য করেছে। বেঁচুকে ভূতের চেলা বলতেও পারো।
কে ভূত?
যে রাতবিরেতে ভয় দেখায় রায়সায়েবকে।
কেন ভয় দেখায়?
ডিস্কোর হুকুমে?
চমকে উঠে বললাম, ডিস্কো।
হ্যাঁ! ডিস্কো। ডিস্কোর লোক কলকাতায় যেমন, তেমনই রাঙাটুলিতেও আছে। ভুলে যাচ্ছ কেন হালদারমশাইয়ের কথা। তাঁকে ডিস্কোর লোকেরাই বেঁধে বলি দিতে যাচ্ছিল না?
এ বাড়িতে ডিস্কোর লোক আছে তাহলে–যাকে আপনি ভূত বলছেন। কিন্তু কে সে?