বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। অমরেন্দ্রর মুখে রক্তখেকো কালো বেড়ালটার কথা শুনেছিলেন। দিনদুপুরে তার এই গতিবিধি ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলল দেখছি। নাহ্। চিচিং ফাঁক-রহস্যের সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক থাকতেই পারে না। বাড়িতে নির্ঘাৎ ভূতপ্রেত আছে। কর্নেল কথাটা বলব ভাবছি, সেই সময় দেখলাম, মধ্যবয়সী একটা রোগাপটকা লোক লাঠি উঁচিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কালো বেড়ালটাকে দেখা যাচ্ছিল না বটে, বোঝা গেল লোকটা বীরবিক্রমে তর্জনগর্জন করে তাকেই তাড়া করেছে।
একটু পরে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, কী বেচু? দিনদুপুরে ভূত ঢুকেছিল ঘরে?
বেচু সেলাম ঠুকে ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে দিল গেটের। কাঁচুমাচু মুখে বলল, কর্তামশাই দিদিকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছেন। বলে গেছেন, আপনি যে-কোনও সময় এসে যাবেন, লক্ষ্য রাখিস। কিন্তু স্যার, এদিকে এক বিচ্ছিরি উৎপাত।
কালো বেড়াল?
আমরা ভেতরে ঢুকলে বেচু গেটে আবার তালা আটকে দিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার। সবে এত ক্ষণে খেয়েদেয়ে উঠেছি, ব্যাটাছেলে কোত্থেকে এসে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। রোজ যখন-তখন এসে জ্বালাচ্ছে। কার বেড়াল কে জানে! তবে সাংঘাতিক বেড়াল স্যার। রক্ত খায়।
প্রাঙ্গণ পেরিয়ে বেচু আমাদের হলঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর বলল, গতবার এসে যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরেই আপনাদের থাকবার ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু আমারও ভুল, দিদিমণিরও ভুল। চাবি দিদিমণির কাছে। এখানেই একটু জিরিয়ে নিন বরং। আমি খাওয়াদাওয়ার যোগাড় করি। দেরি হবে না।
সে সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে দিল। কর্নেল বললেন, আমরা ট্রেনেই খেয়ে নিয়েছি বেচু। তুমি বসো। রায়সায়েব ফেরা না পর্যন্ত গল্প করা যাক।
বেচু মেঝেয় বসল। কর্তামশাই হরনাথবাবুর বাড়ি গেলেন। আপনি তো স্যার চেনেন হরনাথবাবুকে। ওঁকে কাল থেকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনছি, মাঠের ফার্ম থেকে ডাকাতরা ফল নিয়ে গেছে। আজকাল রাঙাটুলিতে ডাকাতদেরই রাজত্ব।
কর্নেল বললেন, কালো বেড়ালটার গল্প শোনা যাক বেচু! বেড়ালটা নাকি রাত্রিবেলা এসে এই ঘরে রক্ত খাচ্ছিল? এ ঘরে রক্ত এলো কোথা থেকে?
বেচু বিবর্ণ কার্পেটের একটা কোণার দিকে আঙুল তুলল। ওইখানে একটুখানি রক্ত পড়ে ছিল। কিসের রক্ত, কী করে ওখানে এল–আর কালো বেড়ালটাই বা কোত্থেকে এসে সেই রক্ত চাটছিল, কিছুই বোঝা যায় না। তবে স্যার, কিছুদিন থেকে বাড়িতে ভূতপেরেতের উৎপাত হচ্ছে, তা-ও ঠিক। সে জন্যেই দিদিমণি কর্তামশাইকে কলকাতা যেতে বলেছিল। আপনি গতবার এসে উড়ো চিঠি লিখে ভয় দেখানোর জন্য যোগেনবাবুকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। এবার কিন্তু উড়োচিঠি নয় স্যার। রাতবিরেতে নানারকম শব্দ। তারপর ওই বেড়ালটা। এবার স্যার ভূতপেরেতের কাণ্ড।
রোজ রাতেই কি ভূতপ্রেতে জ্বালাচ্ছে? গত রাতে জ্বালিয়েছিল?
বেচু বলল, কদিন থেকে একটু কমেছে। তবে উৎপাত একেবারে বন্ধ হয়নি। কিন্তু ওই কালো বেড়ালটার সাহস খুব বেড়ে গেছে। অবাক লাগে স্যার! চোখের পলকে নিপাত্তা হয়ে যায় ব্যাটাছেলে।
কিন্তু তোমাদের অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা কী করে? তাকে তা দেখতে পাচ্ছি না।
বেচু বিমর্ষ মুখে বলল, কুকুরটা গতকাল মারা গেছে স্যার।
সে কী! কী ভাবে মারা গেল?
ভেতর ভেতর অনেকদিন থেকে অসুখে ভুগছিল। আমরা বুঝতেই পারিনি। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কদিন থেকে। তারপর কাল রাত্তিরে কখন মারা পড়েছে, লক্ষ্য করা হয়নি। বাড়ির পেছনদিকে মরে পড়ে ছিল। ভোরবেলা ওপর থেকে দিদিমণি দেখতে পেয়েছিলেন। কর্তামশাইয়ের আদরের কুকুর। উনি তো কেঁদে কেটে অস্থির। এদিকে ওঁর বন্ধু হরনাথবাবু নিপাত্তা। কর্তামশাই পাগল হতে বাকি। সেজন্যেই দিদিমণি ওঁর সঙ্গ ছাড়ছেন না।
বেচু উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। জিভ কেটে বলল, ভুল হয়ে গেছে। কর্তামশাই আপনার জন্য কফি এনে রেখেছেন। আপনি কফি খেতে ভালবাসেন। আগে কফি করে আনি।
সে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। হলঘরের ভেতরটা লক্ষ্য করছিলাম এতক্ষণ। সেকেলে আসবাবে সাজানো। দেশের বিখ্যাত নেতাদের অয়েল পেইনটিং চারদিকের দেয়ালকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সিলিঙের লোহার কড়িবরগায় মরচে ধরে গেছে। বাড়িটা খুবই পুরনো তাতে সন্দেহ নেই। প্রকাণ্ড দুটো টিকটিকি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে। দেয়াল থেকে বরগা, বরগা থেকে দেয়ালের ছবির আড়ালে তারা ছুটোছুটি করছে। ঘুলঘুলিতে চড়ুইয়ের বাসাও দেখা যাচ্ছিল। এক পাশে তিনটে বইয়ের আলমারি। কারুকার্যখচিত লম্বাচওড়া একটা পেতলের ফুলদানিতে কবেকার ফুলের গোছা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সবখানেই অযত্নের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। পর্দাগুলোও বিবর্ণ এবং জীর্ণ। অমরেন্দ্রবাবুর মেয়ে সুনন্দা কি কিছুতে নজর রাখেন না? মেয়েদেরই নাকি ঘরদোর সাজানোগোছানোর স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। সুনন্দা হয়তো অন্যরকম।
বরগার খাঁজ বেয়ে একটা টিকটিকি আরশোলাকে তাড়া করেছে। আরশোলাটা ফরফর করে উড়ে নেহেরুজির ছবির ফ্রেমে বসল। ছবির পাশেই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেই সিঁড়ি এবং দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় ছাদ থেকে ভেঁড়া বিদ্যুতের একটা কলো তার ঝুলছে। লক্ষ্য করলাম তারটা নেমেছে বরগার খাঁজ থেকে। অথচ আলোপাখার ওয়্যারিং দেয়ালের শীর্ষে আলাদা হয়ে সাঁটা আছে। কালো তারটার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ওটা কিসের জন্য টাঙানো হয়েছিল, এমন সময় কর্নেল আস্তে বললেন, ভূতের কারবার জয়ন্ত।