মাই গুডনেস! চিচিং ফাঁকের সঙ্গে সেই যখের ধনের সম্পর্ক আছে? চুপ! চুপ! কর্নেল সকৌতুকে অট্টহাসি হাসলেন।
যষ্ঠী দরজা খুলে দিলে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কেউ এসেছিল?
আজ্ঞে না তো।
কেউ ফোন করেছিল?
দুবার ফোং করেছিল। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। এখনও ফেরেননি।
নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?
আপনি বেইরেছে শুনেই ফোং কেটে দিল। হ্যালো হ্যালো করলাম—
হ্যালো হ্যালো করেছিস। এবার শিগগির কফি কর।
যেতে যেতে হঠাৎ ষষ্ঠী বলে গেল, একই নোক বাবামশাই। গলা শুনেই বুঝেছি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি খুলে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়েছি, সেইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! ফোনটা ধরো!
ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কেউ বলল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?
আপনি কে বলছেন?
আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে।
লাইন কেটে গেল। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন ভারী এবং কর্কশ। তাছাড়া লেটার বক্সে চিঠি থাকার কথা টেলিফোনে বলাও অদ্ভুত।
কর্নেল তাকিয়েছিলেন। একটু হেসে বললেন, ডিস্কো?
কে জানে? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কি না জিজ্ঞেস করেই বলল, আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে। কেমন বিশ্রী কণ্ঠস্বর।
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে উঁকি মারল। বললেন, লেটার বক্সে এটা চিঠি আছে। নিয়ে আয়। ষষ্ঠী হন্তদন্ত চলে গেল।
বললাম, লোকটা যে-ই হোক, আপনার গলার স্বর ওর কাছে অপরিচিত। আমাকেই আপনি বলে ধরে নিল। এটা একটা পয়েন্ট। নিশ্চয় ডিস্কোর কোনও বোকাসোকা ডামি।
কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ!
একটু পরে ষষ্ঠী ফিরে এল একটা খাম নিয়ে। কর্নেল খামটা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দেখে নিয়ে খুললেন। ভাঁজকরা ছোট্ট একটি চিঠি বের করলেন। তারপর চোখ বুলিয়েই আমাকে দিলেন। দেখলাম, ইংরেজিতে টাইপকরা চিঠি। বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় :
ভদ্রলোকের চুক্তি। ঠিক আছে। কিন্তু কোনও চুক্তিই শূন্যে হয় না। একটা ভিত্তি থাকা উচিত। তাই চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাই রাঙাটুলির হরনাথ সিংহকে অপহরণ করেছি। কথামতো সময়ে জিনিসটি আপনি যথাস্থানে আমার হাতে দিলেই তাঁকে ছেড়ে দেব। ফাঁদ পাতবেন না। তা হলে একটি প্রাণ যাবে।–ডিস্কো
পড়ার পর রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল। বলালম, শয়তানটার কী স্পর্ধা আপনাকে এভাবে চিঠি লিখতে সাহস পেয়েছে?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, ডিস্কো দুঃসাহসী তো বটেই।
উত্তেজিতভাবে বললাম, একটা কথা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। ইন্দ্রজিৎবাবু ডিস্কোর হুমকিতে ভয় পেয়ে আপনার সাহায্য চেয়েছিলেন। অথচ ওঁকে ডিস্কো কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা দিব্যি আদায় করল। আপনি চুপচাপ থাকলেন। আবার শয়তানটা চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাইকে–
হাত তুলে আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, খামোকা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই জয়ন্ত। তোমার কফি হয় তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা হবে।
কিছুক্ষণ পরে কলিং বেল বাজল। কর্নেল বললেন, অরিজিৎ এল হয়তো। তুমি কিন্তু মুখ বুজে থাকবে।
কিন্তু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির বদলে হন্তদন্ত আবির্ভূত হলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে হালদার। ধপাস করে সোফায় বসে হাঁসফাঁস করে বললেন, হরনাথবাবু কিডন্যান্ড। ওনার ওয়াইফ আমারে ট্রাংকলে খবর দিলেন। হরনাথবাবু ওনারে আমার নেমকার্ড দিয়া কইছিলেন, আমার কোনও বিপদ বাধলে জানাই। বলেই তড়াক করে সোজা হলেন। চাপা স্বরে বললেন, রাত্রি সওয়া নয়টার ট্রেনে রওনা দিমু। কর্নেলস্যার। জয়ন্তবাবু। কাইন্ডলি ফলো মি।
তারপর ঘড়ি দেখে সটান উঠে দাঁড়ালেন এবং জোরে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল তুন্বেমুখে বললেন, জয়ন্ত। এবার আর হালদারমশাইকে ফলো করা ছাড়া উপায় নেই।…
৪. আমরা রাঙাটুলি পৌঁছেছিলাম পরদিন
আমরা রাঙাটুলি পৌঁছেছিলাম পরদিন বেলা দুটো নাগাদ। কর্নেলের হাবভাবে কোনও উদ্বেগ বা তাড়াহুড়ো ছিল না। স্টেশনটা মাঝারি ধরনের। অটোরিকশো, সাইকেলরিকশো, ঘোড়ার গাড়ি, এমনকি প্রাইভেট কারও ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা ঘোড়ার গাড়িই ভাড়া করেছিলাম।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ি শহরের শেষ প্রান্তে। রাস্তা থেকে বাড়িটা বেশ উঁচুতে। বাউণ্ডারি ওয়ালে ঘেরা পুরনো আমলের দোতলা বিশাল বাড়ি। চারদিকে গাছপালা জঙ্গল হয়ে আছে। নিরিবিলি সুনসান পরিবেশ। গেট থেকে বাড়িটাকে হানাবাড়ি দেখাচ্ছিল। বললাম, এমন ভূতের পুরীতে ভূতেদের কালো বেড়াল সাজার দরকারটা কী? নিজমূর্তিতেই দেখা দিতে পারে।
কর্নেল হাসলেন। ভূতের স্বভাব হালদারমশাইয়ের মতো। ছদ্মবেশ না ধরলে পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ কীভাবে দেবে?
ঠিক বলেছেন। আমার ধারণা, এবার হালদারমশাইও তাঁর পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে নিশ্চয় ছদ্মবেশে এসেছেন।
কথাটা বলেই চমকে উঠলাম। পাঁচিলের ওপর সত্যিই একটা কালো বেড়াল গুটিসুটি হেঁটে চলেছে। সেই রক্তখেকো কালো বেড়ালটা নিশ্চয়। ব্যস্তভাবে বললাম, কর্নেল! সেই বেড়ালটা।
হ্যাঁ। দেখেছি। কিন্তু গেটে ভেতর থেকে তালা আটকে বাড়ির লোকেরা দুপুরবেলার ভাতঘুম দিচ্ছে নাকি? কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফের বললেন, রায়সায়েবের ঘরের জানালা বন্ধ। সুনন্দার ঘরটা দেখা যায় না এখান থেকে। সত্যকামের ঘরের জানালা বন্ধ থাকা স্বাভাবিক। এখন সে অফিসে। কিন্তু বেচু-মাই গুডনেস। কালো বেড়ালটা বেচুর ঘরের জানালা গলে ঢুকে গেল।