ডিস্কো যদি বাড়ি না চায়?
ওলসন একটু চুপ করে থেকে বললেন, পড়ে থাকবে। আমি চলে যাব।
কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন মিঃ ওলসন।
ওলসন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, অপেক্ষা করে লাভ কী?
ডিস্কোকে আমি ঢিট করে ফেলব। সে যে-ই হোক।
ওলসন মাথা নাড়লেন। বিশ্বাস করি না। রাজনীতিওলারা তার মুরুব্বি।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। ঠিকঠাক জবাব পেলে আমার সুবিধে হবে।
বলুন। আপনাকে আমি কিছু গোপন করিনি। করব না।
আপনি তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তো–
ওলসন কর্নেলের কথার ওপর বললেন, ওঃ! সে এক সুখের দিন গেছে। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছি। স্মৃতি সুখের। আপনার সঙ্গে ডিগবয়ে আলাপ হয়েছিল। যাই হোক, এখন আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। স্মৃতি সুখের বটে, তবে এ মুহূর্তে কষ্টের।
মিঃ ওলসন! আপনি বর্মাফ্রন্টে থারটিনথ ডিভিসনে ছিলেন।
সাধারণ সৈনিক মাত্র।
রিট্রিটের পর ডিভিসন ভেঙে দিয়ে যে দলটাকে রাঁচি ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়, আপনি সেই দলে ছিলেন।
হ্যাঁ। আপনাকে তো কতবার সে-সব কথা বলেছি।
আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এতদিন, আপনার কি অপারেশন অর্কিডের কথা স্মরণে আছে?
ওলসন একটু নড়ে বসলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অপারেশন অর্কিড! বিহারে তখন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল। প্রচণ্ড অন্তর্ঘাত শুরু করেছিল ওরা। ট্রেনের লাইন ওপড়ানো। অস্ত্র লুঠ। আর্মি কনভয়ের ওপর পর্যন্ত হামলা।
১৯৪২সালের আগস্ট আন্দোলন বলা হয়। বিহারে সেই আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ আর্মি অপারেশন অর্কিড শুরু করে। যাই হোক, আপনি কি রাঙাটুলি সেনাঘাঁটি–
ওলসন দ্রুত বললেন, হ্যাঁ। মনে আছে। ওখান থেকে যে সেনাদল অপারেশন অর্কিডে যোগ দেয়, তাতে আমিও ছিলাম।
সামরিক রেকর্ডের একটা বইয়ে পড়েছি, একটা পরিত্যক্ত খনির ভেতর প্রচুর সোনাদানা মজুত রেখেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। খনির মুখ পাথর দিয়ে সিল করে স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। সেই জায়গার একটা ম্যাপ তৈরি করেন লেফটন্যান্ট জেনারেল হেনরি প্যাটার্সন। ম্যাপটা তাঁর ক্যাম্প থেকে পরে কীভাবে চুরি যায়।
ওলসন মাথা নাড়লেন। আমি জানি না। শুনিনি। কিন্তু অপারেশন অর্কিডের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল জায়গাটা খুঁজে বের করা। কারণ ম্যাপ চুরির পর হেনরি প্যাটার্ন আত্মহত্যা করেছিলেন।
ওলসন একটু অবাক হয়ে বললেন, আমাদের যেখানে সেখানে নিয়ে মাটি খোঁড়ানো হতো। মনে পড়ছে। কেন খোঁড়ানো হতো, ভেবেই পেতাম না। আমাদের প্রশ্ন করা নিষেধ ছিল।
কর্নেল আস্তে বললেন, রাঙাটুলির আর্মিবেসের কন্ট্রাক্টর অজয় রায়কে আপনি চিনতেন। ম্যাপ চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহেই তাঁর জেল হয়েছিল। তাই না?
ওলসন তাকয়ে রইলেন কর্নেলের দিকে।
কর্নেল পকেট থেকে পুরনো একটা খাম বের করে বললেন, পুলিশ চন্দ্রিকার ফ্ল্যাট সার্চ করে এই চিঠিটা পেয়েছে। এটা আপনি চন্দ্রিকার মা স্নেহলতা রায়কে লিখেছিলেন।
ওলসন জড়ানো গলায় বললেন, কনডোলেন্স লেটার।
এ হ্যাঁ। অজয়বাবুর মৃত্যুর পর সান্ত্বনা দিয়ে লেখা চিঠি। কিন্তু এতে প্রমাণ হচ্ছে, আপনি অজয়বাবুকে ভাল চিনতেন। তিনি আপনার বন্ধু ছিলেন। এবার আমার প্রশ্ন, ডিস্কো বা তার লোকের চাপে, নাকি চন্দ্রিকা এই চিঠি আপনাকে দেখিয়ে পরিচয় দেওয়ায় আপনি তাকে চার তলার ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছিলেন? আশা করি, সঠিক জবাব দেবেন।
ওলসন আস্তে বললেন, চন্দ্রিকা আমাকে চিঠি দেখিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, এখানে তুমি থাকতে পারবে না। এখানে খারাপ মেয়েরা থাকে। কিন্তু চন্দ্রিকা বলেছিল, তার আশ্রয় নেই। সে কান্নাকাটি করছিল। তাই তাকে ফ্ল্যাটটাতে থাকতে দিয়েছিলাম। পরে বোকা মেয়েটা ডিস্কোর পাল্লায় পড়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে ওলসন আবার বললেন, কথাটা অপ্রাসঙ্গিক ভেবেই আপনাকে বলিনি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিঃ ওলসন! অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি! এটাই সমস্যা আপনি কি জানেন, অজয়বাবু সত্যিই সেই গোপন নকশা চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
ওলসন গম্ভীর মুখে বললেন, আমার সন্দেহ, নকশা উনিই চুরি করেছিলেন। লেফটন্যান্ট জেনারেল প্যাটা জয়ন্তবাবুকে পছন্দ করতেন। বিশ্বাস করতেন খুব। এ কথা অজয়বাবুই আমাকে বলতেন। আমি তো ছিলাম সাধারণ সৈনিক মাত্র।
অজয়বাবুর সঙ্গে কথাবার্তায় তেমন কিছু নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন আপনি?
সম্ভবত। এত কাল পরে কিছু মনে নেই।
ধন্যবাদ! উঠি মিঃ ওলসন।
হ্যারি ওলসন গম্ভীর মুখে রইলেন। গেটের কাছে সেই পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিলেন। চাপা স্বরে বললেন, কী বলছে বুড়ো?
কর্নেল বললেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।
অফিসার হাসলেন। গেলে আমরাও ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই।
গাড়িতে আসতে আসতে বললাম, অপারেশন অর্কিড! আপনি সেইজন্যই পরগাছারহস্য বলছিলেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা গুপ্তধনরহস্য হয়ে দাঁড়াল যে! ছ্যাঃ! যত সব চাইল্ডিশ ব্যাপার!
কর্নেল বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু আড়ালের রহস্যময় ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয় না। কথাটা ঠিকই। বিশাল একটা সাম্রাজ্য। অসাধারণ তার ভৌগোলিক বিস্তার। যুদ্ধের সময় ব্যাঙ্ক এবং ট্রেজারি থেকে কত কোটি কোটি টাকার সোনাদানা শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে, কল্পনা করতে পারবে না। শত্রুপক্ষের বোমায় কত জায়গায় কত সোনাদানার গুপ্তভাণ্ডার চাপা পড়ে গেছে। পরে আর তা খুঁজে বের করা যায়নি। এখনও মাটির ভেতর সেগুলো রয়ে গেছে। যক্ষের দল সেগুলো পাহারা দিচ্ছে।