(ইতিমধ্যে চন্দ্রিকার জীবনকাহিনী হালদারমশাই জেনে নেন। আমরা যতটা জানি, তার বেশি কোনও তথ্য নেই।)
হালদারমশাই সেই বিশেষ গাছটা দিনের বেলায় চিনতে পারেননি, যেটার ডগায় হরনাথবাবু আলো ফেলে কী খুঁজছিলেন। বিকেলে হরনাথবাবু হালদারমশাইকে রাঙাটুলির বিখ্যাত ভবানীমন্দির দেখাতে নিয়ে যান। ফার্মের পশ্চিমে নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের ভেতর প্রাচীন ঐতিহাসিক একটা মন্দির। চারপাশে অজস্র ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরও ভেঙে পড়েছে। শুধু সামনের উঁচু চত্বরটি পাথরের বলে অটুট আছে। তার নিচে হাড়িকাঠ পোঁতা। বৈশাখী পূর্ণিমায় পুজোর সময় বলিদান হয়।
মন্দিরে প্রণাম করে সবে দুজনে উঠেছে, ফার্মের একটা লোক হন্তদন্ত এসে হরনাথবাবুকে একান্তে ডেকে চুপিচুপি কী বলে। অমনই আশ্চর্য ব্যাপার, হরনাথবাবু এক্ষুণি আসছি বলে লোকটার সঙ্গে চলে যান।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন, ফার্মে চুরি-টুরি হয়েছে। কারণ প্রায় নাকি ফার্মে চোর পড়ে। গুদামঘরে প্রচুর ফসল মজুত আছে। হালদারমশাই অ্যালসেসিয়ান কুকুর পোষার পরামর্শও দিয়েছিলেন।
মন্দিরচত্বরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হরনাথবাবু ফেরেননি। তখন হালদারমশাই নদীর দিকে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে দুটো মস্তানমার্কা লোক চুপিচুপি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। তাঁকে দেখেই তারা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
গোয়েন্দার চোখে এ-ও খুব রহস্যময় ঘটনা। কাজেই হালদারমশাই হনহন করে নদীর দিকে যাচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়েন। সেখান থেকে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছিল। লোক দুটো মন্দিরের কাছে যায়। তারপর মন্দিরের পেছনে গিয়ে বসে পড়ে।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্যদিক থেকে টর্চের আলো ফেলে কারা আসছে দেখে হালদারমশাই ভেবেছিলেন হরনাথবাবু। কিন্তু না–এক ভদ্রমহিলা এবং একজন যুবক আলো ফেলে কথা বলতে বলতে আসছে।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন পুজো দিতে আসছে ওরা। কিন্তু চত্বরের সামনে প্রণাম করে ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই রইল টাকা। আমার স্বামীকে তোমরা ফিরে দাও।
মন্দিরের পেছন থেকে সম্ভবত সেই লোক দুটোর একজন হেঁড়ে গলায় বলে, কত আছে?
ভদ্রমহিলা বলেন, গুনে দেখ। পুরো টাকা আছে।
হেঁড়ে গলায় আওয়াজ আসে, ঠিক আছে, চলে যান। আপনার হাজব্যান্ডকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন।
ভদ্রমহিলা এবং যুবকটি চলে যায়। ততক্ষণে হালদারমশাই গুঁড়ি মেরে মন্দিরের চত্বরের কাছে পৌঁছেছেন। তোক দুটো টাকাভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটার দিকে এগিয়ে আসতেই হালদারমশাই উঠে দাঁড়ান। হাঁক ছাড়েন, ডোন্ট টাচ!
সঙ্গে টর্চ ছিল না, রিভলভার ছিল। কিন্তু রিভলভার বের করার আগেই ব্যাগ তুলে নিয়ে ওরা উধাও হয়ে যায়। অন্ধকারে আর কী করা যাবে? টর্চ নিতে ভুল হয়েছে। মনমরা হয়ে হালদারমশাই ফিরে আসছিলেন। নদীর ধারে পৌঁছতেই কাঠের ব্রিজে দুজন লোককে কথা বলতে শোনেন। কাছাকাছি হওয়ামাত্র লোক, দুটো হালদারমশাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, এমন লোকেরা যে একই দলের, সেটা কেমন করে বুঝবেন হালদারমশাই? তারা ওঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। (হালদারমশাইয়ের ভাষায় আমারে বান্ধো ক্যান?) তারপর তারা ওঁকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর সেই মন্দিরের সামনে। তারা হাড়িকাঠে হালদারমশাইয়ের মাথা গলিয়েছে, সেই সময় টর্চের আলো এসে পড়ে এবং হরনাথবাবুর চিৎকার শোনা যায়, এই ব্যাটাচ্ছেলেরা! লোক দুটো হালদারমশাইকে ফেলে পালিয়ে যায়।
হরনাথবাবু তাঁকে মুক্ত করে ফার্মে নিয়ে যান। সব ঘটনা শুনে উনি খুব গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি শিগগির চলে যান রাঙাটুলি থেকে। রাত বারোটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। আপনি আর এখানে থাকলে আমিই এবার বিপদে পড়ব।
কথা শেষ করে হালদারমশাই আবার নস্যি নিয়ে বললেন, হেভি রহস্য। আর হরনাথবাবুর বিহেভিয়ারও মিসটিরিয়াস। কী কন জয়ন্তবাবু?
হালদারমশাইয়ের ভঙ্গিতে বললাম, হঃ!….
.
সে-বেলা হালদারমশাইকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না কর্নেল।
হালদারমশাই স্নান করে ধাতস্থ হয়েছিলেন। ব্যাগ থেকে প্যান্টশার্ট বের করে নোংরা পোশাক বদলে ফিটফাট হয়ে চুল আঁচড়ে খাওয়ার টেবিলে বসেছিলেন। খেতে খেতে তাঁর রাঙাটুলি-অ্যাডভেঞ্চার আবার একদফা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল কোনও প্রশ্ন বা মন্তব্য করেননি। কর্নেলকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে এলাম আমরা। হালদারমশাই সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বললেন, কর্নেলস্যারের রাঙাটুলি যাওয়া উচিত। আমিও যামু। বাট ইন ডিসগাইজ।
হাসতে হাসতে বললাম, আপনার তো সাধুবাবার ছদ্মবেশ ধরার অভ্যাস আছে। ভবানীমন্দিরে গিয়ে ধুনি জ্বেলে বসবেন।
তা কর্নেলস্যার কইলে আপত্তি নাই।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বললেন, হালদারমশাই কি হরনাথবাবুকে চাই চিচিং ফাঁক কথাটা বলেছিলেন?
হালদারমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, ইয়েস। রিঅ্যাকশন বুঝতে চাইছিলাম।
কী বললেন হরনাথবাবু?
শুধু কইলেন, বুঝছি ক্যান চন্দ্রিকারে মারছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেলস্যার। বলে হালদারমশাই হঠাৎ গুম হয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার?
ডিস্কোর লোকেরা আমারে কিডন্যাপ করছিল শুনিয়াই হরনাথবাবু কইছিলেন, সেই ডিস্কো হারামি আবার রাঙাটুলিতে ফিরছে? অরে গুলি করিয়া কুত্তার মতন মারব। জিগাইলাম, ডিস্কো কেডা। শুধু কইলেন, অরে চিনবেন না।