প্রণবকাকু-ফাংশন-টাংশন করতেন, তাঁর কথা বলছেন?
হ্যাঁ। বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও প্রণব চ্যাটার্জি।
প্রণবকাকু এখন বোম্বেতে থাকেন শুনেছি।
তুমিই তা হলে আদি-অকৃত্রিম দীপ্তি রাহা?
তার মানে?
কিছু না। আমার এই কার্ডটা রাখো। দরকার বুঝলে রিং কোরো।
কর্নেল তার হাতে কার্ডটা দিয়ে হন্তদন্ত গাড়িতে উঠে পড়লেন। আমিও দেরি করলাম না। স্টার্ট দিয়ে বললাম, সোজা বেরিয়ে যাই? বেনেপুকুর রোড হয়ে ট্রামডিপোর পাশ দিয়ে এলিয়ট রোড।
কর্নেল সায় দিলেন। একটু পরে বললেন, ডিস্কো বারবার আমাকে বোঝাতে চাইছে, হি ইজ জাস্ট নট আ নেম, হি রিয়্যালি এজিস্টস। হ–সে আছে।
আশ্চর্য! কিন্তু দীপ্তি সেজে যে-মেয়েটা চাবি দিয়ে এল, সে কে?
ডিস্কোর দলে মেয়েও আছে বোঝা গেল।
কিন্তু তারা তো কলগার্ল! ওই মেয়েটিকে কলগার্ল বলে মনে হয়নি।
কিছু বলা যায় না।
কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন। বাকি পথ একেবারে চুপ। সানিভিলার লনে গাড়ি ঢুকলে চোখ খুলে আপন মনে শুধু বললেন, ডিস্কো অসাধারণ ভাল খেলছে!
ষষ্ঠী দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল, হালদারমশাই এয়েছেন!
কর্নেল বললেন, বাঃ! খাসা খবর!
ড্রয়িং রুমের সোফায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রায় লম্বা হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। কর্নেল হালদারমশাই বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে সোজা হলেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, রাত্রে ঘুম হয় নাই। তারপর লং ট্রেনজার্নি! স্টেশন থিক্যা সোজা আপনার হাউসে-ওঃ! হেভি রহস্য কর্নেলস্যার! আপনাগো আশীর্বাদে প্রাণ লইয়া ফিরছি, এই যথেষ্ট।
কর্নেল বললেন, খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম আপনার জন্য। আজ সকালেই জয়ন্তর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, আপনার কোনও বিপদ হলো নাকি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না আপনি।
হালদারমশাইয়ের মুঠোয় নস্যির কৌটো ছিল। এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, বিপদ কইলেন! হেভি বিপদ। হরনাথবাবুর ফার্ম আছে জঙ্গলের কাছে। এগ্রিকালচারাল ফার্ম। তারপর রাত্রিকালে আমারে কিডন্যাপ করল–কী য্যান কয়? হঃ! ডিস্কো।
ডিস্কো! বলেন কী!
আমারে বাঁধতাছে, তহন জিগাইলাম, হু আর ইউ? বান্ধো ক্যান? কয় কী, ডিস্কোর হুকুমে তোমারে বাঁধছি। এবারে মা ভবানীর মন্দিরে তোমারে বলি দিমু।
কর্নেল বললেন, এক মিনিট! কফি খেয়েছেন তো?
হঃ!
তাহলে নিশ্চয় আপনার নার্ভ চাঙ্গা হয়েছে। এবার গোড়া থেকে বলুন, শোনা যাক।
এবার গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাঁর অনবদ্য মিশ্রভাষায় যে বিবরণ দিলেন, তা মোটামুটি এই : রাঙাটুলি পৌঁছুতে সেদিন হালদারমশাইয়ের রাত দশটা বেজে যায়। ট্রেন লেট করেছিল। অত রাতে খোঁজখবর নিয়ে উনি জানতে পারেন, মাইল তিনেক দূরে জঙ্গলের কাছে নদীর ধারে হরনাথ সিংহের কৃষিখামার আছে। হরনাথবাবু রাতে সেখানেই থাকেন। অনেক চেষ্টা করে হালদারমশাই একটা এক্কাগাড়ি যোগাড় করেন। ফার্মে গিয়ে হরনাথবাবুকে চন্দ্রিকা রায়ের শোচনীয় মৃত্যুর খবর দেন। হরনাথবাবু প্রথমে কেঁদে ফেলেন। বলেন, হতভাগিনী নিজেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া কী বলব? তবে হালদারমশাইয়ের মতে, হরনাথবাবু শক্ত মনের মানুষ। হালদারমশাইয়ের খাওয়াদাওয়ার। ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর ফার্মের একটা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থাও করেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, চন্দ্রিকা হালদারমশাইকে কোনও জিনিস রাখতে দিয়েছিল কি না। দেয়নি শুনে গম্ভীর হয়ে চলে যান।
অচেনা জায়গায় হালদারমশাইয়ের ঘুম আসতে চায় না। ফার্মে বিদ্যুৎ আছে। ফ্যানও আছে। জানালার বাইরে আবছা আলোয় একটা ফুলবাগান দেখা যাচ্ছিল। তার একধারে উঁচু কয়েকটা গাছ। হঠাৎ হালদারমশাই দেখতে পান, গাছে ফাঁকে টর্চের আলো ফেলে কে চলাফেরা করছে।
গোয়েন্দাগিরি যাঁর পেশা, তাঁর কাছে এটা সন্দেহজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। উনি চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে যান। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই দেখেন, ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কে এগিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা পুঁড়ি মেরে তাকে অনুসরণ করেন। একটু পরে লোকটা গাছের ডগার দিকে টর্চের আলো ফেলে। তখন অবাক হয়ে যান হালদারমশাই। লোকটা স্বয়ং হরনাথ সিংহ।
এত রাতে হরনাথবাবু একটা ঝাঁকড়া গাছের ডগায় আলো ফেলে কী দেখছেন, এটা রীতিমতো রহস্য। একটু পরে উনি এদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এলে হালদারমশাই চুপিসাড়ে চলে এসে ঘরে ঢোকেন এবং দরজা আটকে শুয়ে পড়েন।
রহস্যটা জানার জন্য হালদারমশাই পরদিন রাঙাটুলিতে থেকে যাওয়াই ঠিক করেন। সকালে চা খেয়ে হরনাথবাবুর সঙ্গে ফার্মের চাষবাস দেখতে বেরোন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে সেই গাছগুলোতে। ফার্মের উত্তর প্রান্তে ওটা একটুকরো জঙ্গল বলা চলে। জঙ্গলটা কেন কাটা হয়নি জিজ্ঞেস করলে হরনাথবাবু বলেন, অর্কিডের চাষ করার জন্য গাছগুলো রেখেছে।
হরনাথবাবু তাঁকে অর্কিড দেখাতে নিয়ে যান। প্রত্যেকটি গাছে প্রচুর অর্কিড রঙবেরঙের পাতায় ঝলমল করছে। হালদারমশাই কর্নেলের কথা তোলেন। কারণ কর্নেলের অর্কিডের হবি আছে। হরনাথবাবু বলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। অমরেন্দ্র সিংহরাযের বাড়ি এসেছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়। (কর্নেলের মন্তব্য : হুঃ) পরে কর্নেল সায়েব তাঁর ফার্মে এসে অর্কিড দেখে গেছেন। যাইহোক, হালদারমশাই কথায় কথায় বলেন, জায়গাটা তাঁর ভাল লেগেছে। একটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। হরনাথবাবু কোন মুখে না বলেন তাঁকে?