কর্নেল সকৌতুকে বললেন, তা ছাড়া আপনি আলিবাবার ভাই কাশেমও নন। কক্ষনো নই। সমস্তটাই দুর্বোধ্য আমার কাছে। অমরেন্দ্র কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বললেন, আপনি বলছিলেন বটুক চৌধুরীর ভূত আমার পিছু ছাড়েনি। আপনি জ্ঞানী মানুষ। ঠিক ধরেছেন। বটুকের লাশ সন্দেহ করে ড্যামের জলে পাওয়া বডিটা পুলিশ ওর চেলাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘটা করে দাহও করেছিল ওরা। কিন্তু আমার সন্দেহ, বটুক মারা পড়েনি। কোনও কারণে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। গতবার আমার কর্মচারী যোগেনকে দিয়ে সে-ই আড়াল থেকে অদ্ভুত সব উড়ো চিঠি লিখত। এখন নিশ্চয় কোনও তান্ত্রিক সাধুর সাহায্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। কেন তা আপনিই বিশদ জানেন।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, এ যুগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপারটাই হয়তো এমন যে পরস্পরের প্রতি রাগ মরে গিয়েও পড়ে না।
হাসি চেপে বললাম, আমাদের নিউজ ব্যুরোর চিফ নগেনদা রাজনৈতিক রাগ বলে একটা টার্ম ব্যবহার করেন।
অমরেন্দ্র কফির পেয়ালা শেষ করে বললেন, কিন্তু আমি তো কবে রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। গত ভোটে আমি তো বটুকের সুবিধে করে দিতেই শেষ মুহূর্তে নমিনেশন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আমার পোষাল না। বটুকের অবশ্য অন্য ব্যাপার। এরিয়ার মাফিয়া ডন ওর হাতে ছিল। যাইহোক, কর্নেল! প্লিজ বটুকের ভূতের হাত থেকে আমাকে বাঁচান।
বলে রায়সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। একটা ফোন করব। অলরেডি আপনার অসাক্ষাতে একটা করেছি–আপনার ওই লোকটিকে বলেই করেছি অবশ্য। হেমেনকে খবর দিয়ে গাড়ি পাঠাতে বলেছিলাম। দশটা বাজতে চলল। এখনও গাড়ি এল না। অদ্ভুত ছেলে তো।
কর্নেল বললেন, রাস্তায় জল জমে গেছে হয়তো। আপনি ফোন করুন।
অমরেন্দ্র রিং করে সাড়া পেলেন। বউমা নাকি? আমি বলছি–হ্যাঁ। হেমেন– আচ্ছা। ঠিক আছে। ফোন রেখে বললেন, বেরিয়েছে এক ঘণ্টা আগে। আপনি ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় জল জমে নিশ্চয় কোথাও আটকে গেছে। বৃষ্টি থেমেছে মনে হচ্ছে। আমি বরং আর অপেক্ষা না করে বাসে বা মিনিবাসে চলে যাই। আপনাকে সব জানালাম। আমি কালই দুপুরের ট্রেনে ফিরে যাব। আপনি কবে যাচ্ছেন বলুন?
কর্নেল বললেন, চেষ্টা করব শীগগির যেতে। রাঙাটুলির ওদিকে জঙ্গলে একরকম অর্কিড দেখেছিলাম। তখন তত মনোযোগ দিইনি। সম্প্রতি একটা বইয়ে ওই অর্কিডের ছবি দেখলাম। আশ্চর্য ব্যাপার। এই অর্কিড–
প্লিজ কর্নেল! অর্কিড পরে হবে। সঙ্গে তোক দেব। যত খুশি কালেক্ট করবেন। আগে বটুকের ভূতটাকে শায়েস্তা করুন। অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার দিকে ঘুরে নমস্কার করলেন। জয়ন্তবাবুকেও আমন্ত্রণ রইল। আচ্ছা, চলি।
ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন কর্নেলের রায়সাহেব। কর্নেল সেই কাগজটা আর আতশ কাচ টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। এতক্ষণে হাসির সুযোগ পেলাম। হাসতে হাসতে বলালম, আপনার বরাতে সব অদ্ভুত মক্কেল জোটে। এই রহস্যটাও কম অদ্ভুত নয়। চিচিং ফাঁক রহস্য।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ব্যাপারটা সম্ভবত হাস্যকর নয়, ডার্লিং। রাঙাটুলিতে গেলে তুমি খানিকটা আঁচ করতে পারবে। বটুক চৌধুরী রায়সায়েবের শ্যালক। হেমেনের কথা শুনলে একটু আগে। হেমেন্দ্র ওঁর একমাত্র ছেলে এবং একজন মস্ত ব্যবসায়ী। আমদানী রফতানির কারবার আছে। যতটা জানি, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। রায়সায়েবের কাছে থাকেন ওঁর একমাত্র মেয়ে সুনন্দা। ভদ্রমহিলা বিধবা। সতুর কথা শুনেছসত্যকাম। সুনন্দা দেবীর ছেলে। মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। দাদামশাই তাকে মানুষ করেছেন। যাইহোক, রাত বাড়ছে। তোমাকে সল্ট লেকে ফিরতে হবে। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যাও।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, হেমেনবাবু কোথায় থাকেন?
বেহালায়। কাজেই তোমাকে কখনই বলা যেত না রায়সায়েবকে একটা লিফট দাও।
হাসলাম। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির মতো কোনও মেয়ে হলে আমি বেহালা কেন, কাকদ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসতে রাজী।
কর্নেল জিভ কেটে বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত তুমি একজন কলগার্লকে ভুলতে পারোনি দেখছি।
আমার কিন্তু ওকে মোটেই কলগার্ল বলে মনে হয়নি। আপনি সম্ভবত ভুল করছেন। মেয়েটি সত্যি ভয় পেয়ে আমাদের গাড়ির কাছে ছুটে এসেছিল। ওর কথাবার্তা, তা ছাড়া চুপচাপ বসে থাকা–সব মিলিয়ে একজন বিপন্ন মেয়েরই হাবভাব লক্ষ্য করেছি।
কথাগুলো জোর দিয়ে বললাম। শোনার পর কর্নেল একটু হাসলেন। বিপন্ন হতেই পারে। কলগার্লদের জীবন তো সবসময় বিপন্ন।….
.
কর্নেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্ক সার্কাস হয়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যেতে যেতে সারাপথ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির কথাই ভাবছিলাম। এ যাবৎ কখনও রাস্তাঘাটে দিনে বা রাতে কোনও একলা, মেয়েকে গাড়িতে লিফট দেওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি, যদিও গপ্পে এসব অনেক পড়েছি। সৌভাগ্য মানে, গল্পে এসব ক্ষেত্রে প্রেমের সুযোগ এসে যায়। দুর্ভাগ্য মানে, অনেক সময় নাকি লিফট দিতে গিয়ে সাংঘাতিক ব্ল্যাকমেলের পাল্লায় পড়তে হয়।
কিন্তু মেয়েটিকে কর্নেল কলগার্ল বলে সনাক্ত করেছে, এমন কি বাড়িটাও চেনেন। এজন্যই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। গাড়ির আলোয় কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওর যে মুখ দেখেছি সেই মুখে সৌন্দর্য ও বিপন্নতার ছাপ ছিল। সুন্দরী মেয়েরা কেন নষ্ট হয়ে যায়, এ ধরনের সামাজিক-নৈতিক প্রশ্নও আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল।