গোপেনবাবুকে আপনি বুঝি বড়বাবু বলেন?
আজ্ঞে। এই কোম্পানির দুই পার্টনার। গেপেনবাবু আর রথীনবাবু। রথীনবাবুকে বলতাম ছোটবাবু। কবছর আগে রথীনবাবু মারা যাওয়ার পর থেকে কারবার বন্ধ হয়ে গেল। ছোটবাবু ভেতর ভেতর কোম্পানিকে ফাঁসিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন। বড়বাবু সরল লোক। রথীনবাবুকে বিশ্বাস করেই সর্বস্বান্ত হওয়ার দাখিল।
রথীন চৌধুরী? বেহালায় থাকতেন শুনেছি?
আজ্ঞে! আপনি চিনতেন? চাঁদুবাবু প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিলেন, চিনবেন বৈকি স্যার। বড়বাবুর চেনা যখন, তখন নিশ্চয় সব শুনেছেনও বটে।
আমি চমকে উঠেই সামলে নিয়েছিলাম। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসা একেই বলে। তবে বরাবর দেখে আসছি, যে-কোনও রহস্যেরই জাল বহু বহু দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। গোপেনবাবু গেলেন তো গেলেন।
চাঁদুবাবু বললেন, এসে পড়বেন। একটু অপেক্ষা করুন। চা-ফা খেতে চাইলে বলুন, এনে দিচ্ছি।
কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, নাহ্। চা খাব না। আপনার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। আপনি তো বহু বছর এ বাড়িতে আছেন।
তা কুড়ি একুশ বছর হবে স্যার।
বাড়ির মালিক কে?
পুরনো মালিক ছিলেন মোহনপুরের মহারাজা। তাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন আগরওয়ালবাবু। মারোয়াড়ি বিজনেসম্যান স্যার। তাঁরই ছেলে এখন মালিক। শুনেছি, বাড়িটা ভেঙে মাল্টিস্টেরিড বিলডিং হবে। কিন্তু হবে কী করে কে জানে! এতগুলো কোম্পানি ভাড়াটে হয়ে আছে। তাদের ওঠাবেন কী করে। ঝামেলা আছে। অনেক ঝামেলা!
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, বড়বাবু বলছিলেন, রাতবিরেতে নাকি এই ঘরে পাড়ার মস্তানরা এসে আড্ডা দেয়।
চাঁদুবাবুর চোখ গুলিগুলি হয়ে উঠল। ফিসফিস করে বললেন,আমি ঠেকাব কী করে। জেনেশুনেও চুপ করে থাকি স্যার। ওরা যখন আসে, বুঝতে পারি। কিন্তু যদি বলি, কে? অমনই বলবে, তোর বাপ। শাসাবে। কী করব বলুন স্যার?
আপনি ওদের দেখলে চিনতে পারবেন?
চাঁদুবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ওরে বাবা! আমার বডি ফেলে দেবে।
না। এমনি কথার কথা বলছি। চেহারা নিশ্চয় মনে আছে? চাঁ
দুবাবু করজোড়ে বললেন, না স্যার! ওসব কথা আলোচনা করবেন না। বড়বাবুও আমাকে নিষেধ করেছেন।
আপনি ডিস্কোর নাম শুনেছেন?
ডিস্কো?
হ্যাঁ, ডিস্কো।
চাঁদুবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, একটু-একটু মনে পড়ছে। একদিন রাত নটা নাগাদ ছোটবাবুর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। ছোটবাবু তাঁকে ডিস্কো বলছিলেন। তখন বড়বাবু ছিলেন না। ছোটবাবু আমাকে মদ এনে দিতে হুকুম করলেন। অত রাত্রে কি উৎপাত দেখুন স্যার! তা–
সেই ভদ্রলোকের চেহারা মনে আছে?
ফর্সা সুন্দর মতো– চাঁদুবাবু আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই স্যারের বয়সী হবেন। একেবারে সায়েবি চালচলন। তা ছ-সাত বছর আগের কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে আপনি ডিস্কো বললেন–ওই কথাটা আজকাল খুব চালু কি না! তাই মনে পড়ে গেল।
বলে চাঁদুবাবু পা বাড়ালেন। যাই স্যার! রান্নার যোগাড় করতে হবে। একা মানুষ। বড়বাবুকে বলবেন যেন স্যার, আমি এসেছিলাম।
চাঁদুবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, ব্যস! অনেক সূত্র পেয়ে গেলেন।
কর্নেল একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। চলো! কেটে পড়া যাক। তবে খুব আস্তে হাঁটবে। চাঁদবাবুর মুখোমুখি পড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
যদি নিচে দেখা হয়ে যায়?
হওয়ার চান্স নেই। তবে নেহাত দেখা হয়ে গেলে চুপচাপ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাব।
.
পাড়ি স্টার্ট দিতেই কর্নেল বললেন, সোজা মৌলালি সি আই টি রোড হয়ে গিন্টন স্ট্রিট। গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার।
বারোটা পনের বাজে। এখনই না গেলে নয়!
ডার্লিং। আজও আমার বাড়ি তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।
তারপর বলবেন, আজও অফিস কামাই করো।
কর্নেল হাসলেন। অফিস কামাই করছ কোথায়? তুমি অফিসে জানিয়ে দাওনি একটা এক্সক্লসিভ ক্রাইম স্টোরির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ? না জানিয়ে থাকলে
দ্রুত বললাম, জানিয়েছি। কিন্তু এখনও তো স্টোরির লেজটুকু ধরে আছি!
লেজ ধরলেই মাথা দেখতে পাবে।
মৌলালির ট্রাফিক জট ছাড়িয়ে যেতেই আধঘণ্টা লেগে গেল। লিন্টন স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, চাঁদুবাবু সম্পর্কে মুখ বুজে থাকবে কিন্তু।
বললাম, আমি সবসময় মুখ বুজে থাকব।
সংকীর্ণ রাস্তাটাকে গলি বলাই চলে। এঁকেবেঁকে কিছুদূর এগিয়ে কর্নেল বললেন, পেয়ে গেছি।
একপাশে গাড়ি রেখে আমরা বেরোলাম। একটা বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন কর্নেল। একটি কমবয়সী মেয়ে দরজা খুলে কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, কাকে চাই?
গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
দাদু তো নেই। ঠাকুমা দাদু পুরী বেড়াতে গেছেন।
তোমার দীপ্তিপিসিকে ডাকো!
মেয়েটি ঘুরে প্রায় চিৎকার করে ডাকল, ছোটপিসি! ছোটপিসি! তোমাকে ডাকছে।
বছর কুড়িবাইশ বয়সী এক তরুণী এসে বলল, আপনারা কোত্থেকে আসছে?
কর্নেল বললেন, দীপ্তি রাহার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার নাম দীপ্তি। আপনারা—
জাস্ট আ মিনিট! আপনার বাবা-মা পুরী গেছেন কবে?
এক সপ্তাহ আগে। সামনের মাসে ফিরবেন। কিন্তু আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি তোমার বাবার একজন বন্ধু। তুমি নিশ্চয় প্রণব চ্যাটার্জিকে চেনো? তোমার বাবার কাছে আসতেন। ওঁর ধর্মতলার অফিসেও যেতেন।