ঘরটা বেশ বড়। কয়েকটা টেবিল এবং অনেকগুলো চেয়ারে সাজানো অফিস। টেবিলগুলো খালি। একপাশে একটা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং চারদিকে গদিআটা চেয়ার সাজানো আছে দেখে বোঝা গেল, এটাই গোপেনবাবুর আড্ডাস্থল। টেবিলে ফোনও আছে। কর্নেল প্রথমে ফোন তুলে পরীক্ষা করে বললেন, ফোনটা চালু আছে।
অশোকবাবু র্যাকের কাছে গিয়ে বললেন, ফাইলের পাহাড় দেখছি! সব নামাতে হলে আমার লোকজনকে ডাকতে হবে।
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, নাহ্। চোখে পড়ার মতো জায়গায় ভ্যাগারটা রাখা হয়েছে।
কৈ? কোথায়?
কর্নেল একটা থাকের মাঝখান থেকে কাগজের একটা মোড়ক টেনে বের করে বলেন, এই নিন। খুলে দেখুন।
অশোকবাবু মোড়কটা টেবিলে রাখলেন। তারপর সাবধানে খুললেন। রক্তের কালচে ছোপমাখা একটা ছোরা দেখা গেল। আমি আঁতকে উঠেছিলাম ছোরাটা দেখে। বললাম, ছোরার বাঁটে খুনীর আঙুলের ছাপ থাকতে পারে।
কর্নেল হাসলেন। পুলিশের গোয়েন্দারা সেটা জানেন। তবে তুমি একটু ভুল করছ জয়ন্ত। খুনীর আঙুলের ছাপ সম্ভবত এতে পাওয়া যাবে না। ডিস্কো বা তার আমি কিংবা তার চেলাদের আঙুলের ছাপও পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কারণ ছোরার বাঁটে গোপেনবাবু হাত দিয়ে থাকতে পারেন।
অশোকবাবু বললেন, যাই হোক। ফরেনসিক ল্যাবে এটা পাঠাতেই হবে।
অবশ্যই পাঠাবেন। বলে কর্নেল আঙুল দিয়ে মোড়কের ভেতর একটা জায়গা দেখালেন। তবে অশোকবাবু, মার্ডার উইপনটা আমাকেই উপহার দিয়েছে ডিস্কো। দেখুন, লেখা আছে : কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে উপহার। ইতি–ডিস্কো।
অশোকবাবু পড়ে দেখে বললেন, আশ্চর্য স্পর্ধা এই লোকটার।
কর্নেল বললেন, স্পর্ধা কি না বলতে পারছি না। তবে সে নিজের অস্তিত্ব বোষণা করেছে।
অশোকবাবু অবাক হয়ে বললেন, ডিস্কো বলে তো কেউ আছেই। পুলিশমহলেও সবাই জানে। নতুন করে তাকে অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হবে কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিন্তু আমার কাছে তাকে বারবার নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হচ্ছে। সম্ভবত সে আঁচ করেছে, তার প্রকৃত পরিচয় জানার কোনও নয় আমার হাতে এসে গেছে।
কী সূত্র?
এটাই সমস্যা অশোকবাবু। মানুষ অনেক সময় জানে না যে সে কী জানে। আমি নিজেই এখনও জানি না যে আমি এমন কী জানি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ডিস্কোর প্রকৃত পরিচয়।
অশোকবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার হেঁয়ালি বোঝার সাধ্য আমার মেই।
কর্নেল মেঝেয় দৃষ্টি রেখে ঘরের ভেতর চক্কর দিতে শুরু করলেন। এই সময় হঠাৎ আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। অশোকবাবু ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেল। আপনাকে চাইছে কেউ।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সে লক্ষ্য রেখেছে আমি এখানে এসেছি। এগিয়ে এসে উনি টেলিফোন নিলেন অশোকবাবুর হাত থেকে। বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ ডিস্কো নাকি? ধন্যবাদ। আপনার উপহার পেয়ে খুশি হয়েছি।…না, না। গোপেনবাবুকে ঝামেলায় ফেলব না। কেন এ কথা ভাবছেন?… নাহ্। আপনার সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও চাইব। আশা করি পাব। …. ধন্যবাদ, ছাড়ছি।
অশোকবাবু আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ডিস্কোর অনেক ডামি আছে শুনেছি। আপনি যদি ভাবেন ডিস্কো নিজে কথা বলল আপনার সঙ্গে, তা হলে ভুল করবেন।
হ্যারি ওলসন ডিস্কোর যে কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, তাঁর সঙ্গে মিলে গেল এবার। এর আগে তার ডামির গলা শুনেছি। ওলসন বলেছিলেন, খুব মিঠে অমায়িক স্বরে কথা বলে ডিস্কো। বলে কর্নেল আবার ঘরের মেঝে পরীক্ষায় ব্যস্ত হলেন।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কাগজেমোড়া ছোরাটা একটা কিটব্যাগে ঢোকালেন। বললেন, আপনি কি কিছু খুঁজছে কর্নেল?
কর্নেল সহাস্যে বললেন, জানি না কী খুঁজছি। তবে বলা যায় না, ওই যে পদ্যে আছে : যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন। স্বভাব অশোকবাবু! আমার এই বিদঘুঁটে স্বভাব কিছুতেই ছাড়তে পারি না।
ঠিক আছে। আপনি ছাই উড়িয়ে দেখুন অমূল্য রতন পান কি না। আমি এটা এখনই গিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
অশোকবাবু বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওধারে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা অশোকবাবুর সঙ্গে চলে গেল।
আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। কর্নেল এবার হাঁটু গেড়ে আতশ কাচ দিয়ে মেঝেয় কী দেখছিলেন। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা হয়েছে। তবু লাল সুরকি জিনিসটা এমন যে, মেঝেয় এঁটে যায়।
লাল সুরকি খুঁজছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। ওলসন হাউসের গলিতে উল্টোদিকে একটা বাড়ি হচ্ছে। গলিতে বৃষ্টিধোয়া লাল সুরকি পড়ে আছে। কাজেই চন্দ্রিকাকে খুনের রাতে যে ওই ছোরা এখানে এনে রেখেছিল, তার জুতোয় সুরকির ছাপ আছে। কাজেই ডিস্কো সত্যিই সহযোগিতা করছে।
কর্নেল দরজার দিকে ঘুরেছেন এবং আমি চেয়ার থেকে উঠেছি, একজন কালো রোগাগড়নের লোকের আবির্ভাব হলো। বড়বাবু নাকি? বলে উনি উঁকি দিলেন ঘরের ভেতর। তারপর কর্নেলকে বললেন, বড়বাবু কোথায় গেলেন স্যার?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, একটু বেরিয়েছেন। কিছু বলতে হবে?
আজ্ঞে না স্যার। শুনলাম, বড়বাবুর ঘরে কারা কথাবার্তা বলছে। তাই—
আপনিই কি এ বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবু?
হ্যাঁ স্যার! চাঁদুবাবু বিনীতভাবে বললেন। বড়বাবু তো আজকাল বিশেষ আসেন না। এলেও বিকেলের দিকে। সেইজন্যে খোঁজ নিতে এলাম, যদি কিছু দরকার-টরকার হয়।