টাটকা রক্ত নয় নিশ্চয়?
না।
গোপেনবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন কিছু?
দীপ্তি বিমর্ষমুখে মাথা নাড়ল। বলল, পুলিশে জানানো মানেই ঝামেলা। বাবা তাঁর বন্ধুদের নিষেধ করেছেন। ড্যাগারটা যেমন ছিল, তেমনই রেখে দিয়েছেন। বাবার এক বন্ধু প্রণব চ্যাটার্জি আপনার নাম ঠিকানা জানেন। তাঁর পরামর্শেই বাবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
প্রণব চ্যাটার্জি? হ্যাঁ–একসময়কার বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বটে। তো আপনার বাবা এলেন না কেন?
বাবা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। ওঁর ধারণা, উনি নিজে আপনার কাছে এলে ওঁকে ফলো করবে মস্তানরা। আসলে বাবা প্রচণ্ড ভীতু মানুষ। তাছাড়া আজকাল মস্তানদেরই রাজত্ব। ওরা যা খুশি করতে পারে। দীপ্তি পাংশুমুখে হাসবার চেষ্টা করে ফের বলল, আমি বাবার পরামর্শে অনেকটা ঘুরে আপনার এখানে এসেছি। প্রথমে গেলাম শ্যামবাজারে পিসিমার বাড়ি। সেখান থেকে এসপ্ল্যানেড। তারপর ট্রামে চেপে এখানে।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলাম। এবার বললাম, কর্নেল! সম্ভকত ওটাই চন্দ্রিকাকে মার্ডারের উইপন। এবার ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে গোপেনবাবুর অফিসের ফোন নাম্বার মিলিয়ে নিন।
দীপ্তি তখনই তার বাবার অফিসের ফোন নাম্বার বলল।
কর্নেল বললেন, আমি আপনার বাবার অফিসে যেতে চাই। অফিসের চাবি দরকার হবে।
দীপ্তি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে রিঙে ঝোলানো একটা চাবি বের করল। চাবিটা কর্নেলকে দিয়ে সে বলল, বাবা চাবিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। কিন্তু– সে কুণ্ঠার সঙ্গে আস্তে বলল ফের, আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে নিষেধ করেছেন। চাবিটা আপনার কাছে থাক। পরে আমি এসে নিয়ে যাবখন।
অফিসের ঠিকানা চাই যে। কর্নেল টেবিল থেকে ছোট্ট একটা প্যাড আর ডটপেন দিলেন। দীপ্তি ঠিকানা লিখতে ব্যস্ত হলো। কর্নেল বললেন, আপনাদের বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নাম্বারও লিখুন। দরকার হলে আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলব।
দীপ্তি প্যাড এবং কলম কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বলল, আমাদের বাড়ির ফোনটা অনেকদিন থেকে ডেড। একটা কথা কর্নেলসায়েব। বাবা তো ভীষণ ভীতু মানুষ, তাই বলছি, বাবার সঙ্গে যদি দেখা করার দরকার হয়, বরং প্রণবকাকুর বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা যায়। প্রণবকাকুর ঠিকানা আমি জানি না। আপনি হয় তো জানেন?
নাহ্। কর্নেল প্যাড থেকে ঠিকানা লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিলেন। আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের বছর আগে আলাপ হয়েছিল। উনি যে আমার কথা মনে রেখেছেন, এতেই আমি খুশি। আপনি ঠিকানা যোগাড় করে আমাকে জানিয়ে দেবেন।
দীপ্তি রাহা চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে মিলল তো?
মিলবে বৈকি। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন। তবে মনে হচ্ছে, ডিস্কো আর ওই ফোন ব্যবহার করছে না কিংবা করবে না।
কেন?
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই চিরকুট দুটো বের করলেন। তারপর পাশের ঘরে চলে গেলেন। আলমারি খোলা ও বন্ধ করার আবছা শব্দ হলো। কর্নেল ফিরে এসে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ। গোপেনবাবুর পোড়ো অফিসে ফাঁইলের তলায় যে ড্যাগারটা আছে, ওটা দিয়েই চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছিল।
ব্যস্তভাবে বললাম, এখনই ওটা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। বলা যায়, ইতিমধ্যে ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে কি না!
হয়নি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
কর্নেল ফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল করে কার সঙ্গে চাপা স্বরে কী সব কথাবার্তা বলার পর ফোন রেখে চুরুট ধরালেন। বললাম, রহস্য কিন্তু আরও জট পাকিয়ে গেল। কারণ ডিস্কো যার হাতে চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি পাঠিয়েছিল, সেই স্বপন দাশকে গুলি মেরে চাবিটা হাতিয়ে অন্য কেউ চন্দ্রিকার ঘরে ঢুকেছে এবং তাকে খুন করেছে। কিন্তু মার্ডারউইপন ডিস্কো পেল কী করে? চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর নিশ্চয় সে-ও ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। নাহ! কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কী বোঝা যাচ্ছে না?
ডিস্কো বা তার ডামি বলুন, কী চেলা বলুন–গোপেনবাবুর অফিসের ফোন ব্যবহার করেছে। কাজেই গোপেনবাবুর অফিস ডিস্কোর একটা ডেরা। সেখানে মার্ডারউইপন লুকিয়ে রাখল কে? কেনই বা রাখল? যদি ডিস্কো ওটা চন্দ্রিকার ঘরে পেয়ে থাকে, সে তার ওই ডেরায় রাখতে গেল কেন?
একটু অপেক্ষা করো। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত আসছেন সদলবলে। তাঁদের নিয়েই আমরা মার্ডারউইপন উদ্ধার করতে যাব। আশা করি, তারপর ডিস্কোর এই খেলার উদ্দেশ্য বোঝা যাবে…
.
ধর্মতলা স্ট্রিটে একটা গলির পাশে বিশাল পুরনো বাড়িটা হঠাৎ চোখে পড়লে দিনদুপুরে কেমন গা ছমছম করে। গলি দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। সিঁড়ির পাশে অগুনতি লেটার বক্স। অনেক কোম্পানি এবং লোকের নাম লেখা প্ল্যাস্টিক বা কাঠের ফলকও আছে। কোনও আলোর বালাই নেই। পুলিশের গাড়ি খানিকটা দূরে একটা চার্চের কাছে উল্টোদিকে পার্ক করা হয়েছিল। লক্ষ্য করলাম, সাদা পোশাকের পুলিশ একজন-দুজন করে বেরিয়ে আনাচে-কানাচে এসে দাঁড়াচ্ছে।
অশোকবাবু, কর্নেল এবং আমি তিনতলায় পৌঁছে করিডরে কাউকে দেখতে পেলাম না। করিডরে ঘুরে গিয়ে বাড়ির কোণার দিকে শেষ হয়েছে। একটা ঘরের দরজায় বেরঙা এক টুকরো ফলকে লেখা আছে পরমা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার্স লিঃ। কর্নেল তালা খুললেন। ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে এল। কর্নেল ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। দক্ষিণের একটা জানালা খুলে দিলেন।