কর্নেল তুষোমুখে বললেন, কার কাছে নেব?
রাঙাটুলি থানায় যোগাযোগ করুন। কিংবা কলকাতায় পুলিশের মিসিং স্কোয়াডে জানান।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ভাঁজকরা দোমড়ানো কাগজ বের করলেন। ভাঁজ খুললে দেখলাম অমরেন্দ্রবাবুর দেওয়া সেই চিচিং ফাঁক।
কাগজটা টেবিলের ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে উনি পাশের ঘরে গেলেন। আবছা কানে এল আলমারি খোলার শব্দ। ফিরে এলেন আরেকটা কাগজের চিরকুট নিয়ে। দেখলাম, এটা চন্দ্রিকার পার্সে আমার খুঁজে পাওয়া সেই কোড নম্বর লেখা কাগজটা।
দুটো চিরকুট পাশাপাশি রেখে আতশ কাচ দিয়ে কী পরীক্ষায় বসলেন কর্নেল। একটু পরে স্বগতোক্তি করলেন, হুঁ!
জিজ্ঞেস করলাম, কিছু উদ্ধার করলেন নাকি?
কর্নেল দুটো কাগজই ভাঁজ করে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বললেন, এই নিয়ে প্রায় পনের বার পরীক্ষা করলাম জয়ন্ত। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে দুটোর মধ্যে প্রশ্নোত্তরের সম্পর্ক আছে। রায়সায়েবেরটা যদি প্রশ্ন হয়, চন্দ্রিকারটা তার উত্তর।
আপনাকে কেউ চাই চিচিং ফাঁক বলে টেলিফোন করছে বলেছিলেন।
গতরাতেও বার দুই করেছিল। অগত্যা বলেছি, চিচিং ফাঁক দেব। তবে একটা শর্তে। ডিস্কো কে আমাকে জানাতে হবে।
কী বলল?
কর্নেল হাসলেন। বলল, আমিই ডিস্কো। তখন বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার আসল নাম এবং ঠিকানা জানান। আমি আপনাকে চিচিং ফাঁক পৌঁছে দেব।
তারপর? তারপর?
রাজী হলো না। বলল, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে রাত্রিবেলা রেখে আসতে হবে। তার বদলে আমার রাহাখরচ বাবদ পাঁচশো টাকা যে কোনও ভাবে আমাকে পৌঁছে দেবে।
অবাক হয়ে বললাম, আবার সেই রাঙাটুলির ভবানীমন্দির?
হ্যাঁ। জায়গাটা গোপন লেনদেনের উপযোগী।
আপনি রাজী হলেন না কেন? ভবানীমন্দিরে পুলিশের ফাঁদ পেতে ডিস্কোকে পাকড়াও করা যেত।
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, কিন্তু যে ফোনে কথা বলছে, সে-ই যে ডিস্কো তার প্রমাণ কী? আমি রিং করে যখন ডিস্কো বা তার কোনও ডামির সঙ্গে কথা বলেছি, তখন কিন্তু চিচিং ফাঁক প্রসঙ্গ সে তোলেনি। কাজেই একজন তৃতীয় ব্যক্তির কথা এসে যাচ্ছে। অরিজিৎও এই তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলছিল, মনে পড়ছে না তোমার?
একটু ভেবে বললাম, তা-ও তো বটে। ডিস্কো চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল স্বপন দাশের হাতে। স্বপনকে খুন করে চাবিটা হাতিয়ে চন্দ্রিকাকে খুন করেছে কেউ এবং সেই খুনের উদ্দেশ্য চন্দ্রিকার পার্সে লুকিয়ে রাখা ওই অদ্ভুত চিরকুট হাতানো। কাজেই তৃতীয় একজনের কথা এসে পড়ছে। সে-ই দেখা যাচ্ছে নাটের গুরু।
কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন, তোমার বুদ্ধি খুলেছে ডার্লিং।
উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে বললাম, এর সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বনাম ডিস্কোর বিরোধ সম্পর্কহীন। তার মানে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ডিস্কোর লড়াই নেহাত প্রেসটিজের লড়াই।
এই সময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে বলল, একটা মেয়েছেলে এয়েছেন বাবামশাই। বললেন, খুব দরকার। আমি বললাম, একটু রোয়েট করুন–
রোয়েট না করিয়ে নিয়ে আয়।
ষষ্ঠী কর্নেলের ভেংচিকাটা বুঝতে পারে। বেজায় গম্ভীর হয়ে চলে গেল। তারপর এক যুবতী ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বলল, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কর্নেল বললেন, বসুন।
একটু দ্বিধার সঙ্গে সে বলল, কথাগুলো কনফিডেনশিয়্যাল।
স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী। আপনি?
আমার নাম দীপ্তি রাহা। লিন্টন স্ট্রিটে থাকি।
যা বলতে চান, জয়ন্তের সামনে বলতে পারেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার কোনও গোপন কথাই আমি আমার এই তরুণ বন্ধুর কাছে গোপন রাখতে পারব না।
দীপ্তি রাহাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সাদামাটা গড় বাঙালি মেয়ের মতো চেহারা। আস্তে বলল, আমার বাবা গোপেন্দ্রনাথ রাহার নাম শুনেছেন কি না জানি না। এক সময় ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন। ধর্মতলায় ওঁর অফিসটা এখনও আছে। ডিস্ট্রিবিউশন কারবার বন্ধ হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে কোনও দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যাঅব্দি অফিসে গিয়ে বসে থাকেন। ওঁর চেনাজানা লোকেরা আড্ডা দিতে আসেন। কিন্তু কিছুদিন থেকে বাবা লক্ষ্য করছেন, ওঁর অফিসের মেঝেয় দামি বিদেশি সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে থাকে। অ্যাশট্রে পোড়া সিগারেটের টুকরোয় ভর্তি। দুদিন আগে মেঝেয় মদের খালি বোতল পড়ে আছে দেখে বাবা ভীষণ রেগে যান। বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবুকে খুব বকাবকি করেন। চাঁদুবাবু বলেছিলেন, কিছুই জানেন না। রাতবিরেতে এরিয়ার মস্তানরা হয়তো ও-ঘরে এসে আড্ডা দেয়। ডুপ্লিকেট চাবি যোগাড় করা তো সহজ। অত বড় তিনতলা বাড়ি। ডাক্তারের চেম্বার এবং অনেকগুলো ছোটখাটো কোম্পানির অফিস আছে। কখন কে কী কাজে বাড়িতে যাতায়াত করছে, চাঁদুবাবুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
কর্নেল অভ্যাসমতো চোখ বুজে হেলান দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, আপনার বাবার ওই অফিসে টেলিফোন আছে?
দীপ্তি বলল, আছে। বাবা ওখান থেকে টেলিফোন খুব কদাচিৎ ব্যবহার করেন। অথচ এ মাসের বিলে চারশোর বেশি কল উঠেছে। মস্তানরা নিশ্চয় টেলিফোনও ব্যবহার করে। কিন্তু এসব তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য বাবা আমাকে আপনার কাছে। পাঠাননি। কাল বিকেলে র্যাকে পুরনো ফাঁইলগুলো থেকে ময়লা ঝুলকালি সাফ করছিলেন। হঠাৎ দেখেন ফাঁইলের তলায় একটা ড্যাগার লুকোনো আছে। রক্তমাখা ড্যাগার।