বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবু! আপনাকে কীভাবে কিডন্যাপ করেছিল ডিস্কো?
ইন্দ্রজিৎবাবু ক্লান্তভাবে একটু হাসলেন। ওলসনের বাড়িতে ডিস্কোকে মিট করতে গিয়েছিলাম। শয়তানটা ফোনে আমাকে ডেকেছিল বোঝাঁপড়া করার জন্য। আমার জেদ চেপেছিল মাথায়। গাড়ি পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে রেখে পায়ে হেঁটে যাব ভাবছিলাম। গাড়ি থেকে নামছি, একটা লোক হাতে চাঁপাফুল নিয়ে এসে বলল, ফুল কিনবেন স্যার? এঁকে দেখুন, দারুণ সেন্ট। সে ফুল নাকের কাছে আনতেই মাথাটা কেমন করে উঠল। তারপর দেখি, আমি একটা ঘরে শুয়ে আছি। খাটের সঙ্গে আমার হাত-পা বাঁধা। মুখে টেপ বাঁধা। মুখোশ পরা দুজন লোক আমাকে পাহারা দিচ্ছে।
কর্নেল বললেন, যাক। আপনি আর বেশি কথাবার্তা বলবেন না। আপনার বিশ্রাম করা দরকার। এভাবে চলে আসাও ঠিক হয়নি।
ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখের তলায় কালো ছোপ। ক্রোধের ছটা চোখের তারায় ঠিকরে পড়ল। এক লাখ টাকা কম কথা নয়, কর্নেলসায়েব। মৃদুলা তার গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে ধারদেনা করে অতগুলো টাকা যোগাড় করেছিল। কিন্তু ডিস্কোর জাল কতদূর ছড়ানো দেখুন। কোথায় রাঙাটুলিতে জঙ্গলের ভেতর পুরনো একটি মন্দির। তার মানে, ডিস্কোর লোক সেখানেও আছে।
সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, যাই হোক, আপনি আবার ফোন করে জেনে নিন, আপনার স্ত্রী রাঙাটুলি থেকে ফিরলেন কি না।
ইন্দ্রজিৎ উঠে গিয়ে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। বোঝা গেল এনগেজড টোন। আবার ডায়াল করলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। তখন থেকে খালি এনগেজড টোন। ডিস্কোর লোক গিয়ে ফোনের লাইন কেটে রেখেছে কি না কে জানে। আমি চলি, কর্নেল।
ইন্দ্রজিৎবাবু বেরিয়ে গেলে বললাম, আবার ওঁকে ডিস্কোর লোকেরা রাস্তায় কিডন্যাপ করতে পারে। পুলিশকে আপনি বলে দিলেও পারতেন।
কর্নেল হাসলেন। শেষরাতে ইন্দ্রজিৎবাবুকে ওরা তাঁর বাড়ির গেটে রেখে গিয়েছিল। বাড়িতে সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর ছেলেরা পাহারায় ছিল। কোনও অসুবিধে হয়নি। সাতটা নাগাদ উনি সঙ্গে দুজন ছেলেকে নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে হাজির। গাড়িতে ওরা আছে। কাজেই ডিস্কো দ্বিতীয়বার কিডন্যাপ করতে চাইলেও পারবে না। ডিস্কো অত বোকা নয়।
বললাম, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে টাকা পেয়েই তা হলে ডিস্কোর লোক ট্রাঙ্ককলে ডিস্কোকে জানিয়েছিল। তাই ইন্দ্রজিৎবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। ডিস্কো কথা রেখেছে। গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ নাকি ইন্দ্রজিৎবাবু তাঁর ঘোর শত্রু! ডিস্কোকে ভদ্রলোক বলা উচিত।
আপনি চন্দ্রিকার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎবাবুর আলাপের ব্যাপারটা তোলেননি?
নাহ্। তুমিও তো দেখলে কী অবস্থা! এই অবস্থায় ওসব কথা তোলা কি উচিত? কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে দুষ্টমির হাসি হাসলেন। এবার ডিস্কোর রিঅ্যাকশন দেখা যাক। এক লাখ টাকা হাতিয়ে শত্রুকে জব্দ করা নয় শুধু, হাতে মাতে বুঝিয়ে দিয়েছে, সাবধান! আমার সঙ্গে লড়তে এসো না।
কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, এনগেজড?
নাহ্। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।
আজকাল টেলিফোনের ওই এক রোগ। আবার ডায়াল করুন বরং।
কর্নেল আবার ডায়াল করলেন। তারপর বললেন, রিং হচ্ছে। সাড়া নেই। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর টেলিফোন রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। ষষ্ঠী আমার জন্য কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, আমার কথাটা আপনি শুনছেন না। আমি বলছি, লাহিড়িসায়েবের সাহায্যে টেলিফোন দফতর থেকে এই গোপন নাম্বারের নাম ঠিকানা যোগাড় করার অসুবিধে কী? নামঠিকানা পেয়ে গেলেই তো ডিস্কোকে পাকড়াও করা যাবে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে শুললেন, তুমি ঠিক বলেছ।
নাম্বার থেকেই তো এলাকা বোঝা যাবে। কোন এলাকার নাম্বার?
টু ফোর।
উৎসাহে নড়ে বসলাম। ধৰ্ম্মতলা স্ট্রিট, তালতলা এলাকা। আমাকে নাম্বারটা দিন না।
কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, ডিস্কোর টেলিফোন নাম্বার ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত আমার মাথাব্যথা নেই। আমি চিন্তিত হালদারমশাই সম্পর্কে। উনি রাঙাটুলি থেকে ফেরেননি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না সেখান থেকে। কোনও বিপদে পড়েননি তো?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদারের কথা ঘটনার পর ঘটনার ধাক্কায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কর্নেলের কথায় টনক নড়ল। এযাবৎ গোয়েন্দা ভদ্রলোকের ক্রিয়াকলাপের প্রবণতা যা লক্ষ্য করে আসছি, তাতে ওঁর এমন চুপচাপ উধাও হয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক। চন্দ্রিকা ছিল ওঁর ক্লায়েন্ট। তার নির্দেশ মতো রাঙাটুলিতে হরনাথবাবুকে বিপদের খবর দিতে ছুটে যাওয়া হালদারমশাইয়ের পেশাগত নীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর ওঁর পক্ষে আরও স্বাভাবিক ছিল ক্লায়েন্টের হত্যারহস্য উদঘাটনে আদাজল খেয়ে নেমে পড়া। অর্থাৎ খবর দিয়েই কলকাতা ফেরা এবং গোয়েন্দাগিরিতে নেমে পড়া–যা কি না অনেকসময় রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সামিল। তবে এ-ও ঠিক, অভিজ্ঞতায় জানি যে উনি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে প্রায়ই ফেঁসে যান। এমন সাংঘাতিক বিপদে পড়েন যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। অবশ্য শেষ মুহূর্তে কর্নেলস্যার গিয়ে ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা-ই তো! হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই কেন? কর্নেল। রাঙাটুলিতে আপনার জানাশোনা লোক আছে। আপনিই ট্রাঙ্ককলে খবর নিন।