কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছুনয়। তবে ইন্দ্রজিত্যাবুর এই বিপদের দিনে ওঁর কাছের মানুষ যারা, তারা ছুটে আসতেই পারে। যাক গে, মহিলাকে কেমন মনে হলো?
শক্ত মনের মানুষ। স্ট্রং নার্ভ। ভেঙে পড়েননি।
ওঁর বাবা অনাথবাবু একেবারে বিপরীত। রাঙাটুলিতে আলাপ হয়েছিল।
কাল রাত্রে আপনি বলছিলেন। কিন্তু উনিই যে ইন্দ্রজিৎবাবুর শ্বশুর, এটা আমাকে চমক দেবার জন্যই কি আপনি গোপন রেখেছিলেন?
কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ভদ্রলোক পরিবেশদূষণ এবং মানুষের ন্যাচারাল হ্যাঁবিটাট নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন করছেন খনি অঞ্চলে। তবে আমাকে একটা অর্কিড প্রজাতির খোঁজ দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কর্নেল হঠাৎ বললেন, বাঁদিকের রাস্তায় চলো। শর্টকাট হবে।
ওদিকে কোথায় শর্টকাট হবে?
আমরা সোজা চৌরঙ্গি এলাকায় যাব। জয়া ট্রেডিং এজেন্সির অফিসে।
সেখানে কী?
অমরেন্দ্রবাবুর ছেলে হেমেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে চাই।…
.
একটা বহুতল বাড়ির দশতলার পুরোটা নিয়ে জয়া ট্রেডিং এজেন্সি। বিশাল কারবার না থাকলে এমন সাজানোগোছানো অফিস করা যায় না। প্রচুর কর্মচারী আর উর্দিপরা বেয়ারা নিয়ে কর্মব্যস্ত একটা আধুনিক প্রতিষ্ঠান। রিসেপশনের কাউন্টারে সুন্দরী যুবতী মোতায়েন। মিঠে হাসিতে মিশিয়ে ফুরফুরে ইংরেজি বলছে। উচ্চারণে মার্কিনি ঢং। অর্থাৎ আনুনাসিক স্বর।
এক মিনিট পরেই একজন বেয়ারা এসে আমাদের নিয়ে গেল মালিকের চোরে।
হেমেন্দ্রবাবুর বয়স আন্দাজ করলাম চল্লিশ বিয়াল্লিশের বেশি নয়। সপ্রতিভ ঝকঝকে চেহারা। চিবুকে দাড়ি। মুখে পাইপ। কর্নেলকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়ালেন।
করমর্দনের পর কর্নেল আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। হেমেন্দ্র একটু হেসে বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম কর্নেলসায়েব এতক্ষণ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর ভূতের পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন।
কর্নেল বললেন, যেতাম। একটু বাধা পড়ে গেল। তো পরশু রাতে তোমার বাবা কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন?
সে এক কেলেংকারি! হেমেন্দ্র হাসলেন। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে জলে আটকে গেলাম। ইঞ্জিনে জল ঢুকে গাড়ি বিগড়ে গেল। ওই অবস্থায় গাড়ি ফেলে রেখে কাছাকাছি একটা গ্যারাজে গিয়ে লোক ডেকে–সে এক বিশ্রি ঝামেলা। বাড়ি ফিরলাম গ্যারাজের একটা গাড়ি নিয়ে। তখন রাত প্রায় একটা। ফিরে দেখি, শালা ঘুমোচ্ছন। জানতাম, আমার অপেক্ষা করবেন না। কিন্তু এই ট্রাজেডির মধ্যে একটা কমেডিও আছে। আমার গাড়ি জলে ডুবেছিল আপনার বাড়ির কাছাকাছি। আসলে শর্টকাটে আসতে গিয়েই পড়লাম অগাধ জলে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে নাকি?
হ্যাঁ। সি দা ফান। তার ওপর লোডশেডিং সারা এলাকায়।
এই রাস্তাটায় আজকাল এক কোমর জল জমে যায়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ললেন, তুমি কি ওলসন হাউস চেনো? ওই রাস্তায় বাড়িটা পড়ে।
হেমেন্দ্র একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। ওলসন হাউস! নামটা চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ–আজই কাগজে পড়েছি। একটা মার্ডার হয়েছে ওই বাড়িতে। আপনি–
হ্যাঁ। আমি ইন্টাররেস্টেড। চন্দ্রিকাকে তুমি চিনতে।
হেমেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে আস্তে বললেন, চিনতাম। দ্যাটস আ লং স্টোরি। কিন্তু আমি আজ কাগজ পড়েই জানলাম চন্দ্রিকা ওই বাড়িতে থাকত এবং কলগার্ল হয়ে উঠেছিল। আশ্চর্য লাগছে, চন্দ্রিকা মাঝে মাঝে আমার অফিসেও আসত। চাকরির জন্য বলত। কিন্তু আমি জানতাম, ওর নামে ওর স্বামীকে মার্ডারের চার্জ আছে। তাছাড়া ওকে তো ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর স্বামী রথীন আমার মামাতো ভাই ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে ওর জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না।
তুমি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে ওকে মিশতে বারণ করতে শুনেছি।
কে বলল? হেমেন্দ্রর চোখ জ্বলে উঠল। ইন্দ্রজিৎ বলল আপনাকে?
ইন্দ্রজিৎকে ডিস্কো নামে কোন মাফিয়া ডন কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা চেয়েছে।
হেমেন্দ্র চমকে উঠলেন। বলেন কী! কে ডিস্কো?
বললাম তো, মাফিয়া ডন। ওলসন হাউসের কলগার্লদের মালিক।
হেমেন্দ্র আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে মনে হচ্ছে। সে বলেছে আমি চন্দ্রিকাকে ওর সঙ্গে মিশতে বারণ করতাম?
না। ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী।
মৃদুলা? মৃদুলা–আশ্চর্য তো!
উত্তেজিত হয়ো না প্লিজ। কর্নেল একটু হেসে বললেন, মৃদুলা ভুল বুঝতেই পারেন। কিন্তু ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল, তোমার মুখেই জানতে চাই।
কফি খান, বলছি।
হেমেন্দ্র সুইচ টিপে ঘণ্টা বাজালেন। একজন বেয়ারা এলে তাকে কফি আনতে বললেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হাসবার চেষ্টা করলেন। মৃদুলাকে নিশ্চয় ইন্দ্রজিৎ ভুল বুঝিয়েছে। ইন্দ্রজিৎ নাটক করে। নিজেকে শিল্পী বলে। কিন্তু এটা ওর চরিত্রের অন্য দিক। মুখোশ বলতে পারেন। আপনি কি জানেন ইন্দ্রজিৎ এক সময় ট্রেড ইউনিয়ন করত ধানবাদ এরিয়ায়? ও ধানবাদেরই ছেলে। আমার মামাবাবু বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন আপনি তো জানেন। মামাবাবুও ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। সেই সূত্রে ইন্দ্রজিৎ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর বাড়ি যাতায়াত করত। তারপর মৃদুলার সঙ্গে কী ভাবে প্রেম-টেম করে ফেলে। মৃদুলার বাবা তখন পাটনা য়ুনিভার্সিটির অধ্যাপক। ইন্দ্রজিৎ মৃদুলাকে নিয়ে কলকাতা চলে আসে। বিয়ে করে। ট্রেড ইউনিয়ন করেই ইন্দ্রজিৎ প্রচুর পয়সা কামিয়েছিল। মামাবাবু জানতেন ইন্দ্রজিৎ রাজনীতিতে তাঁকে ডোবাবে। তাই তার সংশ্রব এড়িয়ে চলতেন। আমি নিজের কানে শুনেছি, মামাবাবু জনসভায় চিৎকার করে ইন্দ্রজিতের দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। এ জন্যই আমার সন্দেহ, ইন্দ্রজিৎ মামাবাবুর বিরুদ্ধে কলকাতায় বসে কলকাঠি নেড়েছে। গত বছর মামাবাবু নিখোঁজ হয়ে যান। তারপর ড্যামের জলে ওর বডি পাওয়া যায়। ইন্দ্রজিৎ পুরনো রাগ ঝাড়তেই ওর একসময়কার চেলাদের দিয়ে মামাবাবুকে মার্ডার করিয়েছিল। এবার বুঝুন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ধরনের ছিল।