ডিস্কো।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন, আপনি কি লাহিড়িসায়েবকে এই চিঠির কথা জানালেন?
মৃদুলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, না।
সুশান্তবুকে নিশ্চয় জানিয়েছেন?
হ্যাঁ। সুশান্ত এই ফ্যামিলিরই একজন।
কী করবেন ভেবেছেন?
সুশান্তর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। সুশান্ত আজই টাকা নিয়ে যাবে। আমিও সঙ্গে যাব। কারণ ভবানীমন্দির সুশান্ত চেনে না।
এত নগদ টাকা যোগাড়-করতে পারবেন?
কর্নেলের কথার ওপর মৃদুলা দ্রুত বললেন, আমি ম্যানেজ করতে পারব।
ডিস্কো কে আপনি জানেন?
না। তবে সুশান্ত বলছিল, ইন্দ্রজিতের কাছে নামটা শুনেছে। বলে একটু দ্বিধার পর মৃদুলা ফের বললেন, সুশান্ত ওর বডিগার্ড। কিন্তু গতকাল ও সুশান্তকে নিয়ে বেরোয়নি। সেই ভুলের জন্যই এ অবস্থা। আমি ওকে একা বেরুতে বারণ করেছিলাম।
আপনি তো রাঙাটুলির মেয়ে। চন্দ্রিকা রায়কে চিনতেন নিশ্চয়?
সুন্দরী মহিলার চেহারায় মুহূর্তের জন্য বিকৃতি ফুটে উঠল। বিকৃত মুখে বললেন, ডেঞ্জারাস মেয়ে। ইন্দ্রজিৎ? আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। নিজের স্বামীকে যে মেয়ে তোক দিয়ে মার্ডার করাতে পারে, তার চরিত্র কেমন ভেবে দেখুন।
চন্দ্রিকার স্বামীকে আপনি চিনতেন?
মুখোমুখি আলাপ ছিল না। শুনেছি, নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে ছিল। তবে ভীষণ মদ খেত–হয়তো ফ্রাস্ট্রেশনের জন্য। তাছাড়া ওর বাবা ছিলেন এম এল এ। সেই জন্য খারাপ লোকেরা ওকে খুব এক্সপ্লয়েট করত। বটুকবাবুকেও রথীনের বোকামির জন্য বিব্রত হতে হতো।
আপনি নিশ্চয় বটুকবাবুর ভাগ্নে হেমেন্দ্রকে চেনেন?
মৃদুলার চোখ জ্বলে উঠল। আমার সন্দেহ, হেমেনদাই ডিস্কো।
কেন সন্দেহ?
চন্দ্রিকার সঙ্গে হেমেনদার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রথীনকে মার্ডারের পেছনে তারও হাত ছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলেছিল এ সব কথা খুলে বলাই উচিত আপনাকে। আমার স্বামীভদ্রলোক এই যে বিপদে পড়েছে, সেটা অকারণ নয়। মৃদুলার মুখে আবার বিকৃতি ফুটে উঠল। চন্দ্রিকাকে নিয়ে হেমেনদার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের রেষারেষি চলছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলত চন্দ্রিকার জীবন হেমেনই নষ্ট করেছে। এদিকে হেমেনদা একদিন আমাকে টেলিফোনে বলছিল, ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার জন্য বিপদে পড়বে। ওকে যেন সাবধান করে দিই।
আপনি ইন্দ্রজিৎবাবুকে বলেছিলেন সেকথা?
মৃদুলা মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন, হ্যাঁ। শুনে ও খেপে গেল। ভীষণ ঝগড়াঝাঁটি হলো আমার সঙ্গে। ইন্দ্রজিতের যুক্তি হলো, চন্দ্রিকার অভিনয় ক্ষমতা নাকি অসাধারণ। সে তার সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অ্যাসেট হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। আমি বুঝতে পারি না কিছু।
সুশান্ত এল। বাড়ির পরিচারিকার হাতে ট্রে। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি এক চুমুক খাব মাত্র–আপনার অনারে। জয়ন্ত পুরো কাপ খাও।
মৃদুলা সুশান্তকে বললেন, তুমি এখনই পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে দেখতো ইসমাইল এখনও কেন এল না গাড়ি নিয়ে। লাহিড়িসায়েব বললেন, বলে দিয়েছেন ওদের। যাবে আর আসবে কিন্তু। সাড়ে বারোটায় ট্রেন। ভুলে যেও না।
সুশান্ত বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়ি?
মৃদুলা বললেন, হ্যাঁ। গতরাতে ওর গাড়িটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গিয়েছিল। তখন টেলিফোনে আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গেছে? গত রাতে?
হ্যাঁ। লাহিড়িসায়েব খবর দিয়েছিলেন। লোক পাঠিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি যখন ডিস্কোকে টাকা দিয়ে ইন্দ্রজিৎবাবুর মুক্তি চেয়েছেন, তখন আর আমার কিছু করার নেই। তো–
মৃদুলা ওঁর কথার ওপর বললেন, আমি রিস্ক নিতে চাই না। টাকার চেয়ে প্রাণের দাম বেশি। ওঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। হাতের চেটোয় মুছে ফের বললেন, যদি ভালয়-ভালয় ওকে ফিরিয়ে আনতে পারি, আর নাটক করতে দেব না। কত অচেনা মেয়ে ওর গ্রুপে নাটক করতে আসে। হয়তো আবার কারও জন্য ও বিপদে পড়বে।
কর্নেল বললেন, একটা প্রশ্ন। আপনার বাবার নাম কী?
আমার বাবা একজন সায়েন্টিস্ট। একসময় অধ্যাপনা করতেন। ছেড়ে দিয়ে কী সব রিসার্চ করেন। আমার বাবা ভীষণ খেয়ালি মানুষ। আসলে আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেছেন। কোথায় কোথায় বনজঙ্গল পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান।
বাই এনি চান্স, আপনার বাবার নাম কি অনাথবন্ধু রায়?
মৃদুলা আস্তে বললেন, হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
কাগজে ওঁর লেখা পড়েছি। ইকোলজিস্ট উনি।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলা বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। সকাল অব্দি জানতাম না টাকার জন্য ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করেছে। তা হলে আপনাকে আসতে নিষেধ করতাম।
কর্নেল পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, শুধু একটা চিঠির ওপর ভরসা করে আপনি অত টাকা নিয়ে যাবেন? ধরুন যদি কোনও থার্ড পার্টি এই ঘটনার সুযোগে টাকাটা হাতাতে চায়?
মৃদুলা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শান্তভাবে বললেন, আমি বোকামি করছি না কর্নেল সায়েব! চিঠিটা পাওয়ার পরে টেলিফোনে কিডন্যাপার ইন্দ্রজিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছে, টাকা না দিলে ওরা ওকে মেরে ফেলবে। আমার স্বামীর গলার স্বর আমি চিনি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছি।
আই সি। কর্নেল একটু হাসলেন। ঠিক আছে চলি! বলে জোরে পা ফেলে বেরিয়ে এলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটের কাছে গেলে এবার সুশান্তের বয়সী অন্য একটি যুবক গেট খুলে দিল। আর একজনকে গেটের পাশে বসে থাকতে দেখলাম। রাস্তায় পৌঁছে বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর থিয়েটারের লোকেরা সবাই ওঁর বাড়িতে থাকে। নাকি?