ভদ্রলোক বললেন, বিকেলে হাওড়া পৌঁছেছি। স্টেশন থেকে ফোনে লাইন পেলাম না। তার ওপর আজকাল আপনাদের কলকাতার কী অবস্থা হয়েছে! ট্যাক্সি, পেতে সে এক হাঙ্গামা। সারা রাস্তা জ্যাম। ব্যস। তারপর শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। অবশেষে যদি বা এসে পৌঁছুলাম, শুনি আপনি নেই।
কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ইনি অমরেন্দ্র সিংহরায়। জয়ন্ত, তুমি কি কখনও রাঙাটুলি গেছ? ধানবাদ খনি এরিয়া থেকে সামান্য দূরে এক অসাধারণ জায়গা। শহর বলতে পারো, আবার গ্রামও বলতে পারো। টিলাপাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা আর নদী–তো রায়সায়েব! এর নাম আমার কাছে শুনে থাকবেন। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
আমরা নমস্কার বিনিময় করলাম। অমরেন্দ্র বললেন, নামটা শুনে থাকব। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল জয়ন্তবাবু। আপনি কাগজের লোক! নিশ্চয় বটুক চোধুরীকে চিনতেন। আমাদের এলাকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বটুক চৌধুরী। হঠাৎ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিয়ে কত তোলপাড়। পরে ওর বডি পাওয়া যায় ড্যামের জলে।
বললাম, নাহ্। চিনি না তাকে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, চৌধুরীসায়েবের ভূত কি এখনও রায়সায়েবের পিছু ছাড়েনি?
অমরেন্দ্র অমনই গম্ভীর হয়ে গেলেন। চাপাস্বরে বললেন, এবারকার ব্যাপারটা একবারে অন্যরকম। গত বছর তো আপনি গিয়ে রহস্যটা ফাঁস করলেন। যোগেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এবার উড়ো চিঠি নয়। আপনি ভূত বললেন–কতকটা তা-ই।
যেমন?
প্রায় প্রতি রাত্রেই এটা হচ্ছে। অদ্ভুত সব শব্দ। বুঝলেন? হলঘরের কাঠের সিঁড়িতে, কখনও ছাদে, আবার কখনও দোতলায় আমার ঘরের বারান্দায় হাঁটাচলার শব্দ। ফিসফিস কথাবার্তা। অমরেন্দ্র সিংহরায়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। অথচ দেখুন, আলশেসিয়ানটা ছাড়া থাকে। সে-হারামজাদার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, যোগেনের মতো বেচুও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বেচুকে রাত্রে ঘরে তালা আটকে রাখলাম। কিন্তু তবু সেই ভুতুড়ে কারবার। টর্চ বন্দুক নিয়ে বেরোই। সুনন্দা, সতু আমার সঙ্গে থাকে। ছাদে উঠে দেখি কেউ নেই। তারপর গত পরশু রাত্রে নিচের হলঘরে আর্তনাদ শুনলাম। সুনন্দা, সতু, বেচু সবাই। শুনেছিল। আলো জ্বালাই থাকে সারারাত্রি। কিন্ত সেরাত্রে তখন লোডশেডিং ছিল। হলঘরে সবাই দেখলাম কেউ নেই, কিন্তু কার্পেটে খানিকটা রক্ত পড়ে আছে।
কুকুরটা তখন কোথায় ছিল।
বাইরে। সতু হলঘরের দরজা খুলতেই লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকল।
অবাক হয়ে শুনছিলাম। বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু কর্নেল তুষো মুখে শুনছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে পারলাম না, রক্ত না রঙ, পরীক্ষা করা হয়েছে?
অমরেন্দ্র সিংহরায় হাসবার চেষ্টা করে বললেন, জয়ন্তবাবু! রক্ত আর রঙের তফাত বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। তা ছাড়া সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হলো, কুকুরটাকে আবার বাইরে বের করে দিয়ে হলঘরের দরজা আটকে আমরা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছি, বেচু মানে আমাদের বাড়ির সারভ্যান্ট চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ} ও নিচের একটা ঘরে থাকে। সতু টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। বেচু বলল, ওই দেখুন। একটা কালো বেড়াল রক্ত খাচ্ছে। সত্যি তা-ই! তাড়া করতেই বেড়ালটা বেচুর ঘরে ঢুকল। সেখানে তাড়া খেয়ে খোলা জানালা গলিয়ে পালাল।
বললাম, তবু কুকুরটার কোনও সাড়া পেলেন না?
নাহ।
ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল এতক্ষণে। বাইরে বৃষ্টিটা সমানে ঝরছে। ভূতের গল্প শোনার মতো পরিবেশ বলা চলে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে বুঝতেই পারছিলাম না উনি বানিয়ে বলছেন কিংবা তিলকে তাল করছেন, নাকি সত্যিই এই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্য আমার এই প্রখ্যাত রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছেন?
কর্নেল বললেন, কফি খান রায়সায়েব। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
কফিতে চুমুক দিয়ে অমরেন্দ্র বললেন, গতরাত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ভোরবেলা আমার ঘরের দরজা খুলে দেখি, একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে আছে। যা অবস্থা চলেছে, স্বভাবত কৌতূহল জাগল। কাগজটার ভাঁজ ঠিকঠাক করে দেখলাম কী সব ইংরেজিতে লেখা আছে। একবর্ণ বুঝলাম না সুনন্দা আর সতুকে দেখালাম। ওরাও বুঝতে পারল না। তখন তিনজনে মিলে ঠিক করলাম, আবার আপনার শরণাপন্ন হওয়া দরকার। এই দেখুন।
অমরেন্দ্র পাঞ্জাবির ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। কাগজটার অবস্থা দেখে বোঝা গেল, ওটা সত্যি দলপাকানো ছিল। টেনে ঠিকঠাক করা হয়েছে। কর্নেল ভাঁজ খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশ কাচ বের করলেন। পড়ার পর শুধু বললেন, হুঁ। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
অমরেন্দ্র বললেন, যোগেনের হাতের লেখা নয়, এটুকু আমি বুঝতে পেরেছি। আপনিই সেবার যোগেনের হাতের লেখা সনাক্ত করেছিলেন।
কর্নেল সায় দিলেন। বললাম, দেখতে পারি? কর্নেল কাগজটা আমাকে দিলেন। লাল ডটপেনে লেখা আছে :
CHAICHICHINGFANK
বার কতক পড়ার পর বললাম, দেখুন, আমার মনে হচ্ছে এতে লেখা আছে চাই চিচিং ফাঁক।
কর্নেল হাসলেন। হুঁ, ঠিক ধরেছ। চাই চিচিং ফাঁক।
অমরেন্দ্র হাসলেন না। রুষ্ট মুখে বললেন, সেটাই তো অদ্ভুত। আমার বোনপো সতুও তা-ই পড়ল। কিন্তু মানেটা কী এর? আরব্য উপন্যাসের আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পে চিচিং ফাঁক বললে নাকি লুঠের মালরাখা ঘরের দরজা খুলে যেত। আমি আলিবাবা না চোরদের সর্দার?