একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ভিজে যাচ্ছি কিন্তু সেজন্যও না। যুবতীর কণ্ঠস্বরে ছটফটানি ছিল এবং সে বারবার ভয়-পাওয়া চোখে ফুটপাতের দিকে তাকাচ্ছিল। প্লিজ যদি আমাকে একটু লিফট দেন। দুটো মস্তান মতো লোক আমার পিছু নিয়েছে।
কর্নেল ঘুরে পেছনকার দরজার লক খুলে দিলেন। যুবতীটি তক্ষুণি গাড়িতে ঢুকে পড়ল। বুঝলাম, কর্নেলের সৌম্যকান্তি এবং ঋষিসুলভ দাড়িই তাকে সাহায্যপ্রার্থিনী করেছে। না হলে এমন অবস্থায় কোনও অচেনা লোকের গাড়িতে কোনও একলা যুবতী এভাবে ঢুকে পড়ত না।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যেতে চান?
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।
অসুবিধে হবে না। আমরা এলিয়ট রোডে যাচ্ছি। জয়ন্ত, সামনের মোড়ে ঘুরে পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কী বলো?
মনে মনে বিরক্ত হলেও বললাম, ঠিক আছে।
জ্যাম ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। কর্নেল আবার অর্কিড নিয়ে পড়লেন। আমার মন ব্যাকসিটে। মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে এবং কথাবার্তাও যেটুকু শুনলাম, মার্জিত উচ্চারণ–ভদ্ৰপরিবারের বলেই মনে হচ্ছে। স্বভাবত আগ্রহ ছিল, কী তার নাম, কোথায় একা গিয়েছিল এবং কী ভাবে দুটো লোক তার পিছু নিল। কিন্তু আমার বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটি কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দিলেন না। পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকে বললাম, কোথায় নামবেন বলবেন।
বেশি দূরে নয়। বলে সে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। কিন্তু ফ্রি স্কুল স্ট্রিট প্রায় অন্ধকার। বড় দোকানপাট আজ রবিবারে বন্ধ। শুধু পান-সিগারেটের দোকানে মোম জ্বলছে। লোডশেডিং এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
কিছুক্ষণ পরে সে বলে উঠল, এখানে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে শুধু অসংখ্য ধন্যবাদ বলে অন্ধকারে বাঁদিকের ফুটপাতে অদৃশ্য হলো।
কর্নেল বললেন, তা হলে দেখ জয়ন্ত, যা বলছিলাম–
ঠিকই বলছিলেন। জীবনের সর্বত্র নাটক। রাস্তাঘাটেও নাটক। হাসতে হাসতে এলাম। জানি না এটা একই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক কিনা বলে গাড়ি ডাইনে ঘুরিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকলাম। দূরে আলোকিত বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছিল।
ডার্লিং?
ঝটপট বললাম, প্লিজ কর্নেল। আর কখনও ডার্লিং বলবেন না। আপনার ডার্লিং শুনে আমাদের কাগজের জনৈক সমালোচক বেজায় খাপ্পা হয়ে গেছেন। তা ছাড়া আপনি কথায় কথায় বড্ড বেশি ইংরেজি বলেন। এও নাকি ওঁর পক্ষে বিরক্তিকর।
কর্নেল কান করলেন না আমার কথায়। বললেন, ডার্লিং! অর্কিড বা পরগাছা গাছপালার জগতে যেমন, মানুষের জীবনেও তেমনই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আসলে মানুষের সভ্যতার একটা অদ্ভুত লক্ষণও কিন্তু এই অর্কিড জাতীয় পরজীবী সম্প্রদায়। হয়তো বা আমরা প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও সময় অর্কিডের ভূমিকা নিয়ে বেঁচে থাকি।
আহ্ কর্নেল! দার্শনিক তত্ত্ব থাক। ওই মেয়েটি সম্পর্কে কী মনে হলো, বলুন।
ওকেও তুমি অর্কিড বলতে পারে।
কী মুশকিল! আপনার মাথায় অর্কিডের ভূত ঢুকে গেছে দেখছি।
জয়ন্ত! মেয়েটি পরজীবী শ্রেণীর।
তার মানে?
আমরা একজন কলগার্লকে লিফট দিলাম।
গাড়ির গতি কমিয়ে বললাম, বলেন কী!
যে বাড়িতে ও ঢুকে গেল, সেই বাড়িতে কিছুদিন আগেই পুলিশ হানা দিয়েছিল। তুমি সাংবাদিক। তোমার মনে পড়া উচিত, এক ডজন কলগার্লকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল। ওদের কেউ কেউ নার্কোটিকসের কারবার করত। সেদিনকার খবর।
একটু হেসে বললাম, বাড়িটা আপনার চেনা দেখছি।
কর্নেল এতক্ষণে হাসলেন। শুধু বাড়িটা নয়, মালিকও আমার চেনা। ভদ্রলোক একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। হ্যারি ওলসন নাম। গোবেচারা নিরীহ মানুষ। বয়স প্রায় আশির ওপরে। আসলে কলগার্ল বা নার্কোটিকসের ব্যাপারটা ওঁর এক্তিয়ারের বাইরে। তো যা বলছিলাম–সেই অর্কিড, বিষাক্ত অর্কিড শরীরে গজিয়েছে হ্যারি ওলসনেরও। ফলে তার অবস্থা কল্পনা করো।
কল্পনা করছি এখন সবখানে সবকিছুই অর্কিডে ঢাকা। আমার ভয় হচ্ছে কর্নেল, শেষে আপনি না আপনার প্রিয় ষষ্ঠীচরণকেও অর্কিড ভেবে বসেন। তা হলে কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে কফির আশা বৃথা।
কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। লক্ষ্য করলাম, আবার চোখ বুজে হেলান দিয়েছেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত চুরুট।
কিছুক্ষণ পরে এলিয়ট রোডে কর্নেলের সানি ভিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে গাড়ি পোর্টিকোর তলায় দাঁড় করালাম। আমার আর সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কর্নেল আমাকে যেতে দিলেন না। অগত্যা গাড়ি পার্ক করে রেখে ওঁর সঙ্গ ধরতে হলো।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে চাপাস্বরে বলল, এক বুড়োবাবু এয়েছেন। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। ফিরতে রাত্তির হবে। উনি বললেন, যত রাত্তির হোক, রোয়েট করব। তা–
তিনি কি রোয়েট করছেন?
আজ্ঞে। ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, জোর করে ঢুকে বললেন, আমি তোমার বাবামশাইয়ের বন্ধু।
কর্নেল তার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, শীগগির কফি।
ছোট্ট ওয়েটিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে ঢুকে উনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো রায়সায়েব?
ঢুকে দেখি, প্রায় কর্নেলের বয়সী এবং তাঁর মতোই দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোক সোফায় বসে আছেন। কিন্তু তাকে কেন কর্নেল রায়সায়েব বলে সম্ভাষণ করলেন বোঝা গেল না। ভদ্রলোকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। পাশে একটা কাপড়ের ব্যাগ। চেহারায় অবশ্য বনেদী আভিজাত্যের ছাপ আছে। দেখনসই পাকা গোঁফ এবং চুলও সাদা। তবে কর্নেলের মতো টাক নেই।