অরিজিৎ! অনাথরা অনেক সময় পরগাছা হয়ে ওঠে।
অরিজিৎ একচোট হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎ পরগাছা নামে একটা নাটক করেছে। আমাকে দেখতে যেতে বলেছিল। শুনলাম, আপনি দেখে এসেছেন। নাটকে কি অনাথ নামে কোনও চরিত্র আছে?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, নাহ্। তবে অনাথ–অনাথ.. বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। জাদুঘরসদৃশ এই ড্রইংরুমের কোণার দিকে গিয়ে ওঁর ছোট্ট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। একটা নোটবই বের করতে দেখলাম। পাতা উল্টে কিছু দেখে নিয়ে ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। অরিজিৎ তোমাদের সেই বন্ধুর নাম কি অনাথবন্ধু রায় ছিল?
অরিজিৎ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, পদবি মনে নেই। তবে অনাথবন্ধু বটে। খুব খেয়ালি ধরনের ছেলে ছিল মনে পড়ছে। ওকে আমরা সবসময় উত্ত্যক্ত করতাম।
রাঙাটুলিতে গিয়ে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ইনিও খেয়ালি। পরিবেশদূষণ নিয়ে আন্দোলন করে বেড়ান নানা জায়গায়। জানি না ইন্দ্রজিৎবাবুর নাটকের আইডিয়া ইনিই যুগিয়েছিলেন কি না।
অরিজৎ ঘড়ি দেখে বললেন, যাক্, ওসব কথা। যেজন্য এসেছিলাম, বলি। প্রথমত, বেলেঘাটার ক্যানেলে ডিস্কোর লোক স্বপনের ডেডবডি পাওয়ার কথা তো আপনি জেনেছেন। স্বয়ং ডিস্কোই জানিয়েছে। তবে দ্বিতীয় ঘটনা হলো, বেলা দুটোর পর ওলসন হাউস থেকে আমরা পুলিশ তুলে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ হ্যারি ওলসন থানায় ফোন করে জানান, দোতলার একটা মেয়ে ওঁকে এইমাত্র বলে গেল, চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে। তখনই অশোক গুপ্ত গিয়ে এনকোয়ারি করেন। কিন্তু চন্দ্রিকার ঘর আগের মতোই তালাটা আছে। দোতলার সেই মেয়েটি ওঁকে অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, লোডশেডিংয়ের সময় নাকি লোকটাকে ওপরে উঠতে দেখেছিল। অশোকবাবুর মতে, চন্দ্রিকার কোনও পুরনো খদ্দের। কারণ লোকটা ডিস্কোর চেলা হলে দোতলার মেয়েটি চিনতে পারত।
আর কিছু?
নাহ্। তবে অশোকবাবু আমাকে ঘটনাটা জানানোর পর আমার মনে হচ্ছে, চন্দ্রিকার এমন কোনও ডকুমেন্ট আছে, যা খুনী এখনও হাতাতে পারেনি। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আপনার চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। হয়তো আপনিই সেটা আবিষ্কার করতে পারবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার খুনী ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওর ঘরে যেটা খুঁজছে, সেটা বেহাত হয়ে গেছে। চন্দ্রিকা বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল।
কিন্তু ডকুমেন্টটা কী হতে পারে?
একটা সাংকেতিক সূত্র লেখা কাগজ।
অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনার হাতের তাস আপনি আগে দেখাতে চান না জানি। কাজেই আর কোনও প্রশ্ন করব না। শুধু একটা রিকোয়েস্ট, ডিস্কোকে বলুন, ইন্দ্রজিৎকে আর যেন উত্ত্যক্ত না করে। সৌরভ নাট্যগোষ্ঠী নিয়েই বেচারার যা কিছু উচ্চাকাঙক্ষা। সব সময় প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকলে ওর নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে ওর দলে নাকি ডিস্কোর চর ঢুকেছে।
চন্দ্রিকা বেঁচে নেই। কাজেই ডিস্কো আর ইন্দ্রজিৎবাবুর পেছনে লাগবে কেন? কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে নিয়ে বললেন, তোমাকে জানানো উচিত, ইন্দ্রজিৎবাবুই বরং ডিস্কোর পেছনে লেগেছেন।
অরিজিৎ হেসে উঠলেন। আসলে চন্দ্রিকার সঙ্গে ওর এমোশনাল অ্যাফেয়ার ছিল বলে আমার ধারণা। তাই ডিস্কো বা তার লোক চন্দ্রিকাকে মেরেছে ভেবেই ইন্দ্রজিৎ খাপ্পা। আমি ইন্দ্রজিৎকে বলেছি, তুমি নির্ভয়ে নাটক চালিয়ে যাও। আর যেন কলগার্লদের ছায়া মাড়িও না। দলের কাকেও ডিস্কোর চর সন্দেহ হলে তাড়িয়ে দাও। ব্যস! ফুরিয়ে গেল।
একটা কথা, অরিজিৎ!
বলুন।
কিছুদিন আগে ওলসন হাউসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। সত্যিই কি নার্কোটিকস পাওয়া গিয়েছিল কলগার্লদের কাছে?
অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, নাহ্। ওটা পাবলিক খাওয়ানো খবর। জাস্ট আ শো বিজনেস।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির অনুরোধে তুমিই হানার ব্যবস্থা করেছিলে কি?
হুঁ! অরিজিৎ সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, ইন্দ্রজিতের ধারণা, ডিস্কো ওকেই ওয়ার্নিং দিতে চন্দ্রিকাকে ওর প্রেমিকা এবং চর ভেবে খুন করেছে। ইন্দ্রজিৎ আজ বলছিল, হানা দেওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যা ঘটল, দেখা যাচ্ছে চন্দ্রিকাকে খুনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কাজেই এখন ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, হচ্ছে ডিস্কো বনাম ইন্দ্রজিতের দ্বন্দ্বের সঙ্গে চন্দ্রিকার মার্ডারের কোনও সম্পর্ক নেই দেয়ার ইজ আ থার্ড ম্যান।
দ্যাটস রাইট। কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন।
আমি চলি কর্নেল! আমরা থার্ড ম্যানকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আপনিও করুন। তবে ডিস্কোকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ওর শত্রুতার আর কারণ নেই। আমি ইন্দ্রজিৎকে একই কথা বলেছি।
অরিজিৎ লাহিড়ি চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোকে ফোন করবেন না?
কেন? লাহিড়িসায়েব ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে মিটমাট করিয়ে দিতে বলে গেলেন।
সমস্যা হলো জয়ন্ত, ডিস্কোর ডামি আছে অনেকগুলো। যতক্ষণ না আসল ডিস্কোকে পাচ্ছি, ততক্ষণ ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তার মিটমাট করানোর চেষ্টা বৃথা। কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। ফের বললেন, মানুষের ছায়ার সঙ্গে তো আর রক্তমাংসের মানুষের মিটমাট করিয়ে দেওয়া যায় না। ডিস্কো এখনও ছায়া। ছায়াটা কার এটাই প্রশ্ন।