কর্নেল তাঁর জোরালো অট্টহাসিটি হাসলেন।
সাড়ে ছটা বাজে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, কোথায় যাবেন বলুন?
শ্যামবাজার এরিয়ায়।
চন্দ্রিকার সেই অ্যাডভোকেটের কাছে নাকি?
হ্যাঁ।
ওর কার্ডটা আপনি রেখে দিয়েছেন তা হলে?
নাহ। টুকে রেখেছি ঠিকানাটা। সার্কুলার রোডে পৌঁছলে কর্নেল ফের বললেন, ঠিকানাটা ডিস্কোরও দরকার হয় কি না জানতে চেয়েছি। তাই কার্ডটা পার্সেই রেখেছিলাম।
সারা পথ ট্রাফিক জ্যাম। কর্নেলের কাছে কলকাতার অলিগলি প্রায় যাকে বলা চলে নখদর্পণে। পাঁচমাথার মোড় পেরিয়ে বাগবাজারে, তারপর কর্নেলের নির্দেশে একটা গলি-রাস্তায় ঢুকলাম। তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। গলিটায় কোনওক্রমে দুটো গাড়ি পরস্পরকে পেরিয়ে যেতে পারে। একটা লোক অলক সেনগুপ্তের বাড়ি দেখিয়ে দিল। এমন এঁদো গলিতে বিশাল বনেদি বাড়ি দেখে তাক লেগে গেল। গেটের অবস্থা অবশ্য ভাঙাচোরা। নামেই গেট। কোনও কপাট বা গরাদ দেওয়া আগড় নেই। সামনে একটুকরো খোলা জায়গা। সেখানে গাড়ি দাঁড় করলাম।
গাড়ি থেকে বেরুতেই সামনের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেদ্ধাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পরনে ফতুয়া আর ধুতি। উনিশ শতকের প্রতীক বলা যায়। সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। হাতে একটা ছড়ি দেখতে পেলাম। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন মনে হলো। কর্নেল নমস্কার করলে উনি বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, কোত্থেকে আসা হচ্ছে মশাইদের?
আমরা অলকবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনিই কি—
আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন। আসুন! ভেতরে আসুন।
ঘরের ভিতরে একধারে তক্তপোশের ওপর ধবধবে সাদা চাঁদরে ঢাকা গদি আর কয়েকটা তাকিয়া। কয়েকটা আলমারিতে আইনের বইপত্র ঠাসা। ঘরের অন্য অংশে অফিস ধরনের টেবিল চেয়ার পাতা। আমাদের গদি দেখিয়ে বসতে বললেন অলকবাবু। নিজে একটা চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। মুখে অমায়িক হাসি। কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিলে চশমার কাছে ধরে খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, কর্নেল নিলাদ্রি সরকার? আপনি কর্নেল?
রিটায়ার্ড।
হুঁ, তা নেচারিস্ট মানে?
প্রকৃতিচর্চা করি।
অলকবাবু সকৌতুকে হাসলেন। কিন্তু আমি তো আইনচর্চা করি কর্নেলসায়েব। প্রকৃতির সঙ্গে আইনের সম্পর্ক তো থাকার কথা নয়।
এক্ষেত্রে আছে। কর্নেলও কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন। রাঙাটুলি প্রকৃতির স্বর্গ। কাজেই–
অলকবাবু চমকে উঠলেন। রাঙাটুলি? রাঙাটুলির চৌধুরীবাড়িতে আমার জানাশোনা ছিল। বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন। ওঁদের ফ্যামিলির অনেক কেস আমি লড়েছি। বটুকবাবুর ছেলে রথীন খুন হয়েছিল। খামোকা রথীনের বউকে অ্যারেস্ট করল পুলিশ। রথীনের বউ আবার আমার আরেক মক্কেল হরনাথ সিংহের মাসতুতো ভাই অজয়ের মেয়ে।
চন্দ্রিকা রায়?
চেনেন নাকি? অলকবাবু আরও অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা খুলে বললে, ভাল হয়।
বটুকবাবুর ভগ্নীপতি অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার বন্ধু। সেই সূত্রে চন্দ্রিকাকে চিনি।
অ। কিন্তু চন্দ্রিকা তো নিখোঁজ হয়ে গেছে কবছর আগে।
জানি। আমি ওর বাবা অজয়বাবুর সম্পর্কে জানতে চাই।
অজয় তো কবে মরে গেছে। অজয়ের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে হরনাথের কাছে উঠেছিল। হরনাথই ভুলটা করেছিল। রথীন হারামজাদার হারামজাদা। জেনেশুনে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। তো আপনি অজয় সম্পর্কে জানতে চান। অমরেন্দ্রর কাছে আমার চেয়ে ভাল জানতে পারবেন।
আপনি বলুন, প্লিজ!
অলকবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝেছি। আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। কাজেই অজয় সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কোনও কারণ আছে। কিন্তু সে তো সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্যাপার। নতুন করে এতবছর পরে ফাঁইল ধুলল কে?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, সি বি আই।
হুঁ, । তা-ই বলুন। আপনারা সি বি আই অফিসার। দেখুন কর্নেলসায়েব, আমি একজন লইয়ার। কাজেই আই মাস্ট কোঅপারেট উইদ ইউ। অজয় সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, তা আমার মক্কেল হরনাথের সূত্রেই জানি। অজয় রাঙাটুলির মিলিটারি বেসে কন্ট্রাক্টর ছিল। পরে কী কারণে নাকি কন্ট্রাক্টারি যায়। জেল খাটতেও হয়েছিল। শুনেছি জেলে থাকা অবস্থাতেই সে মারা পড়ে।
অজয়বাবুর স্ত্রী বেঁচে আছেন কি?
নাহ্। সে কবেকার কথা। চন্দ্রিকা তখন বাচ্চা মেয়ে। এখন চন্দ্রিকার বয়স বোধ করি পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশিও হতে পারে।
হ্যাঁ। বেবিফেস যাকে বলে। বয়স বোঝা যায় না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার হয়ে আপনি কলকাতায় মামলা লড়েছিলেন। তার মানে রথীনবাবু খুন হয়েছিলেন কলকাতায়?
ঠিক বলেছেন। বেহালায় রথীন থাকত। শুনেছি, অমরবাবুর ছেলেও বেহালায় থাকত। পাশাপাশি বাড়িতে থাকত ওরা। তো সি বি আইয়ের কেসটা কিসের কর্নেল সায়েব?
অজয়বাবুকে ব্রিটিশ সরকার কী অপরাধে ফাঁসিয়েছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত উঠেছে।
কার তদ্বিরে? বটুকবাবু তো শুনেছি বেঁচে নেই। কে গভর্মেন্টকে চাপ দিল এতদিন পরে?
আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু অজয়বাবু সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বুঝেছি। চিন্তিত মুখে অলকবাবু বললেন, চন্দ্রিকাকে খুঁজে বের করুন। বাবার কথা সে-ই আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে। রথীনকে খুনের দায়ে তাকে খামোকা পুলিশ ফাঁসিয়েছিল। তারপর মেয়েটা রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গেল।
আপনি সম্ভবত আর প্র্যাকটিস করেন না?