কর্নেল শুধু বললেন, দেখা যাক।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমার কেন যেন মনে হলো, ভদ্রলোক নিছক নাটকের লোক নন।…
২. অনেক জটিল রহস্যের উন্মোচন
এ যাবৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক জটিল রহস্যের উন্মোচন দেখেছি। কিন্তু কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলিনি। আমি থেকেছি নিছক দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু এবার নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার গাড়িতে পার্স ফেলে গিয়ে চন্দ্রিকাই আমাকে যেন জড়িয়ে গেছে তার শোচনীয় মৃত্যুর সঙ্গে।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ডার্লিং! আমার ধারণা, তোমার মগজে প্রচুর পরগাছা গজাতে শুরু করেছে। উপড়ে ফেলো।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম, ওপড়ানো শক্ত। মাথা ঝিমঝিম করছে।
বরং ছাদে গিয়ে বসবে চলো। আমার ছাদের বাগানটিকে হালদারমশাই শুন্যোদ্যান নাম দিয়েছে। শুন্যোদ্যানে কিছুক্ষণ কাটালে মগজ শূন্য হবে। ওপরে বিশাল আকাশ। ওঠো!
বাড়িতে থাকলে কর্নেল তার ছাদের বাগানে দুবেলা কাটান। অদ্ভুত কিম্ভুত সব উদ্ভিদের পরিচর্যা করেন। উনি যখন থাকেন না, তখন কাজটা ষষ্ঠী চমৎকারভাবে করে। সে বলে, আমি গাঁ-গেরামের মানুষ দাদাবাবু। শউরে হওয়া আমার উচিত নয়। ভাগ্যিস বাবামশাই ছাদে বাগানখানা বাইনেছিলেন। পেরানটা শান্ত হয় সেখানে ঢুকলে। ষষ্ঠী গ্রামের মানুষ বলেই গাছপালার প্রতি ওর হয়তো নাড়ির টান।
সে কফির পেয়ালা নিতে এসে বলল, আপনারা বেরুবেন নাকি?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বেরুব।
তাইলে আপনাদের শীগগির বেরুলেই ভাল হয়। সাড়ে চারটে বাজে। বাগানে জল দিতে হবে। নেট হয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, নেট হলেও ক্ষতি নেই। গতরাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছে।
তবু–
ওরে হতভাগা! আমরা বাগানের দিকেই বেরুচ্ছি। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, ঘণ্টাখানেক পরে আবার কফি চাই কিন্তু।
ওপরে গিয়ে শেডের তলা থেকে খুরপি আর কিসের একটা প্যাকেট নিলেন কর্নেল। আমি একটা বেতের চেয়ার নিয়ে গিয়ে ভোলা জায়গায় বসলাম। চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের পাশে ছাদের বাগানটার কথা মনে পড়ে গেল। ওলসন হাউসের ছাদে ওই বাগানটা কি চন্দ্রিকাই করেছিল? প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
কর্নেল একটা বিদঘুঁটে গড়নের ক্যাকটাসের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন, চন্দ্রিকা এখনও তোমার পিছু ছাড়েনি দেখছি।
একটু চটে গিয়ে বললাম, কী আশ্চর্য! আপনার ছাদের বাগানে এসে ওই বাগানটার মনে পড়া কি স্বাভাবিক নয়?
স্বাভাবিক। কর্নেল গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, তাই বলে আমার বাগানের সঙ্গে তুলনা কোরো না! জয়ন্ত! এখানে পৃথিবীর কত দুর্গম অঞ্চল থেকে আনা বিচিত্র সব প্ল্যান্ট আছে তুমি তো ভালই জানো। যাই হোক, কলকাতার একটা সুন্দর বিকেলকে খুনখারাপির ভাবনা দিয়ে নোংরা কোরো না।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকলাম। কিন্তু বারবার গতরাতের দৃশ্যটা ভেসে উঠে আমাকে উত্তেজিত করছিল। কলগার্ল হোক, মানুষ তো! কে তাকে অমন নৃশংসভাবে খুন করল? এ খুনের উদ্দেশ্য কী?
আগাগোড়া কাহিনীর আকারে ঘটনাগুলো পর-পর সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বারবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোনও পূর্ণাবয়ব পারম্পর্যময় কাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব মনে হচ্ছিল। শুধু একটা ব্যাপার স্পষ্ট, চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো চিরকুটে লেখা কথাগুলো যদি কোনও রহস্যময় কোড হয়, সেটাই তার মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ডিস্কোর পাঠানো লোকটাকে গুলি করে মেরে খুনী চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি হাতিয়েছিল। তারপর চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে এসে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছে। চন্দ্রিকা চিৎকার করে কারও সাহায্য চায়নি কেন? খুনী তার চেনা লোক কি না, এ-ও একটা পয়েন্ট। তবে এখন মনে হচ্ছে, ওই চিরকুটটা হাতানোই তার উদ্দেশ্য ছিল।
ষষ্ঠী কফি এনেছিল।-কফি খেতে খেতে আবার চিন্তাগুলো ফিরে এসেছিল। আবার এলোমেলো ঘটনার ঝড় আমাকে অস্থির করে ফেলল। হঠাৎ একটা পয়েন্ট মাথায় এসে গেল। খুনী থিয়েটার থেকে চন্দ্রিকাকে বৃষ্টির মধ্যে অনুসরণ করে এসে বাড়ির কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল কি? তা হলে আমার গাড়ির পিছনে তার গাড়ি ছিল। তারপর সম্ভবত আড়ি পেতে সে সব শোনে এবং ডিস্কোর পাঠানো লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। লোডশেডিং এবং বৃষ্টি তার সুযোগ করে দিয়েছিল। স্পষ্ট দেখা যায়, বর্ষাতিপরা একটা লোক। তার গাড়ি আছে।
প্রশ্নটা কর্নেলের কাছে তুললাম। উনি সেই কাগজের প্যাকেট থেকে একটা ফুলগাছের গোড়ায় কিছু ছড়াচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে আবাক চোখে তাকালেন। কি সর্বনাশ! তুমি মারা পড়বে দেখছি। না–তার মানে, তুমি পাগল হয়ে যাবে বলতে চাইছি। সাবধান ডার্লিং! কক্ষনো রহস্য নিয়ে ছেলেখেলা করতে নাই।
ছেলেখেলা কেন বলছেন?
হ্যাঁ। রহস্য নিয়ে অহেতুক চিন্তাভাবনা করাটাই ছেলেখেলা। রহস্য ফর্দাফাঁই করতে হলে অবশ্য একটা থিওরি গড়ে তোলা দরকার। তারপর তথ্য হাতড়াতে হয়। তথ্য থিওরির সঙ্গে না মিললে নতুন থিওরি গড়ো। কিন্তু তোমার কোনও থিওরিই নেই। আছে শুধু বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্যকে কেন্দ্র করে গড়া নিছক একটুকরো ধারনা। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমাদের সামনে একটা বিশাল কালো পর্দা টাঙানো। পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কর্নেল খুরপি রাখতে গেলেন শেডে। আপাতত কোনও থিওরি গড়ে তোলা অসম্ভব, জয়ন্ত। তাই এই কেসে আমি শুধু তথ্য আর ঘটনার দিকে লক্ষ্য খছি। যাই হোক, একটু পরে আমরা বাইরে বেরুব। আরও তথ্য পেতে চাই বলেই প্রচুর ছোটাছুটি করতে হবে। তোমার মতিগতিথেকে বুঝেছি, তুমি তাতে পিছপা নও।