কর্নেল একটু ঝুঁকে টেবিলের ওপর। বললেন, আপনি মর্গে গিয়েছিলেন কেন মিঃ মজুমদার?
শ্যামলকান্তি এবার একটু দুঃখিত মুখে বললেন, এতেও কোনো রহস্য নেই। আমার এক ভাই অমলকান্তি প্রায় সাত বছর নিরুদ্দেশ। রাত্রে এক বন্ধুর বাসায় ছিলুম। সে বলল, কে এক বাঙালি যুবক আত্মহত্যা করেছে প্রিয়দর্শী হোটেলে। আসলে এ আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, কর্নেল! কলকাতার সমস্ত মর্গে প্রতিদিন একবার করে যাওয়া চাই-ই। বাইরে যেখানেই যাই, কোথাও কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন ধরুন, হোটেলে এক বাঙালি যুবকের আত্মহত্যা, আমি তার খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারি না। অমল আমার বুকের একখানা পাঁজর ভেঙে দিয়েছে, কর্নেল!
শ্যামলকান্তি শ্বাস ছেড়ে রুমালে নাক মুছলেন। বেয়ারা খাবার দিয়ে গেল। চুপচাপ খেতে শুরু করলেন। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। হঠাৎ কেউ আস্তে বলল, জেরা লেট কিয়া হাম!
কর্নেল দেখলেন এক শক্তসমর্থ গড়নের জ্যাকেট-জিনস পরা যুবক। বয়স তিরিশ-বত্তিরিশের মধ্যেই–তপেশের প্রায় সমবয়সী। কিন্তু মুখে উজ্জ্বলতা আছে। স্মার্টনেস ঝলমল করছে।
শ্যামলকান্তি পরিচয় করিয়ে দিলেন কর্নেলের সঙ্গে। যুবকটির নাম সুভদ্র সিং। এখানকার এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাবা একসময়ে বড় জমিদার ছিলেন। মারা যাওয়ার পর সুভদ্র ব্যবসা করছে। পেট্রলপাম্প, গ্যারেজ এসব আছে। মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, সো ইউ আর আ ডিটেকটিভ অফিসার?
কর্নেল হাসলেন। মোটেও না! জাস্ট এ ন্যাচারালিস্ট। তবে ক্রিমিনলজি সম্পর্কে একটু কৌতূহল আছে মাত্র।
শ্যামলকান্তি বললেন, কফি অর টি সুভদ্র?
সুভদ্র বলল, নাথিং শ্যামলদা! এইমাত্র খেয়ে বেরিয়েছি। তো গিয়েছিলেন মর্গে? আমি তো গিয়ে আপনাকে খুঁজেই পেলাম না।
শ্যামলকান্তি গম্ভীর ও বিষণ্ণ মুখে বললেন, গিয়েছিলুম।
বডি দেখলেন?
হ্যাঁ। অমল নয়, অন্য কেউ।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা, চলি শ্যামলবাবু!
শ্যামলকান্তি বললেন, থাকছেন, নাকি ফিরে যাচ্ছেন কলকাতা?
থাকছি না। ওবেলা ফিরছি।
ট্রেনে?
কর্নেল হাসলেন।…বাসে বড্ড ভিড় হয়। এ বয়সে ট্রেনেই আরামদায়ক।
শ্যামলকান্তি একটু ভেবে বললেন, ওবেলা সুভদ্র জিপে কলকাতা যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। চলুন না আমাদের সঙ্গে। আপনার মতো স্বনামধন্য মানুষকে সঙ্গী পেলে আমরা খুশি হব।
কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন।…ভাল হয়। ট্রেন বড্ড দেরি করে এ লাইনে। আমার একটু তাড়াতাড়ি ফেরাও দরকার। আপনারা কখন রওনা দিচ্ছেন?
সুভদ্র বলল, জাস্ট তিনটেতে। বড় জোর ঘণ্টা সাত লাগবে জিপে। রাস্তা খুব ভাল।
ঠিক আছে। আমাকে তাহলে প্রিয়দর্শী থেকে তুলে নেবেন।
কর্নেল বিদায় নিয়ে বেরুলেন রেস্তোরাঁ থেকে। হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের দিকে চললেন। হু, শ্যামলকান্তির কৈফিয়তে সন্দেহজনক কিছু দেখা যাচ্ছে না। যদি তপেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ বা পরিচয় থাকত, মোতিগঞ্জ স্টেশনেই। সেটা বোঝা যেত। ওরা পরস্পর অপরিচিত বলেই মনে হয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা হতে দেখেননি। এমন কী, চোখে-চোখেও কোনো যোগাযোগ হয়নি।
হোটেলে পৌঁছুনোর কিছুক্ষণ পরে মোহন শর্মা এলেন। বললেন, দুজন ঢুকেছিল বডি দেখতে। একজন–
মাথায় হনুমান টুপি, পরনে স্যুট, হাতে অ্যাটাচি কেস?
অবাক শর্মা বললেন, দ্যাটস রাইট। বাট—
দ্বিতীয় জন কে?
লেট কুমার অমর সিং-এর ছেলে সুভদ্র সিং? তাকে চতুর্বেদী জিগে করেছে, মর্গে কেন? সে বলেছে, তার পরিচিত এক বাঙালি ভদ্রলোকের এখানে আসার কথা। তার এক ভাই নিরুদ্দিষ্ট।
সুভদ্র সিং সম্পর্কে পুলিশ রেকর্ডে কিছু উল্লেখযোগ্য আছে।
মোহন শর্মা হাসলেন।…অতীতে থাকলেও আমার জানার কথা নয়। তবে এটুকু বলতে পারি দুবছর এখানে এসেছি। তার বিরুদ্ধে কোনো রেকর্ড এই দুবছরে পাইনি। আমার পূর্ববর্তী অফিসারও কিছু উল্লেখ করে যাননি। তবে সুভদ্র কলকাতার কলেজে লেখাপড়া করেছে, এটুকু জানি। হি ইজ আ নাইস চ্যাপ!
কর্নেল বললেন, মিঃ শর্মা, শুধু একটা অনুরোধ, তপেশের আইডেন্টিটি কার্ডটা কলকাতার ডিটেকটিভ ডিপার্টে অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দেবেন।
শর্মা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। তবে দ্যাটস মাই জব অলসো৷…
০৪. এক সেকেন্ডের জন্য
জিপগাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে এগোচ্ছিল।
বাঁদিকে সুভদ্র ড্রাইভার, ডানদিকের সিটে কর্নেল। শ্যামলকান্তি বসেছে পেছনে, ভেতরদিকে। রাস্তা তত ফাঁকা না হলেও ঝকঝকে নতুন। দক্ষিণে পনের কিমি এগিয়ে এবার চাড়াই-উত্রাই শুরু। ছোটনাগপুর পাহাড়ের একটা রেঞ্জ এখানে উঁচিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দুধারে টিলা, শালের জঙ্গল। গঙ্গা ক্রমশ দূর উত্তরে সরে যাচ্ছে। সমতল মাটির উর্বরতা চোখে পড়ছে না আর। রাস্তা বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হলে শ্যামলকান্তি বললেন, সুভদ্র, এক কাজ করলে হত! সুভদ্র বলল, বলুন শ্যামলদা!
একটা শর্টকাট করলে মন্দ হয় না। শ্যামলকান্তি পরামর্শ দিলেন। আর দশ কিলোমিটার পূর্বে যে চৌমাথাটা পড়বে, ডাইনে ঘুরে দুমকা রোড পাবে। কিন্তু সোজা এগোলে রেললাইন ক্রশ করার ঝামেলা। তাছাড়া মুর্শিদাবাদে ঢুকে চৌত্রিশ নম্বর হাইওয়ে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। হাইওয়েটাও যাচ্ছেতাই। তার চেয়ে দুমকা রোড ধরে চলল।