তিনজনে প্রাঙ্গণের প্রকাণ্ড বটতলায় গেলেন। এদিকটা হাসপাতালের শেষ প্রান্ত। দেয়াল ও ঘন ঝোপঝাড় আছে। কয়েক মিনিট পরে একটা মোটরগাড়ি এসে মর্গের নিচে থামল। ডাঃ মুখার্জি বেরিয়ে এলেন। এঁদের দেখে হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল।
কর্নেল বললেন, পোস্টমর্টেমটা শিগগির করে ফেলা দরকার ডাঃ মুখার্জি।
ওক্কে! আই অ্যাম রেডি। বলে ডাঃ মুখার্জি বারান্দায় উঠলেন। তার গাড়িটা পিছিয়ে গিয়ে কিছুদূরে গ্যারেজের কাছে থামল। সেই ডোম দুজনকে দেখা গেল পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। ডাঃ মুখার্জি সদলবলে মর্গের তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
এর মিনিট পাঁচেক পরে টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে দেখা গেল। তার পরনে স্যুট, মাথায় হনুমান টুপি, হাতে অ্যাটাচি কেস। তিনি এদিকে এলেন না। বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে পড়লেন। সিগারেট ধরালেন।
আরও একজন লোক এসে একটু তফাতে বসল। সাধারণ চেহারা ও পোশাকের মানুষ। তারপর এক বৃদ্ধা, সঙ্গে একটি যুবক এবং একটি বালক।
শর্মা হাসলেন।…ভিড় শুরু হলো। আজকাল যত খুনোখুনি বেড়েছে, তত বেড়েছে নিরুদ্দিষ্ট লোকজন। কাজেই বুঝতে পারছেন কর্নেল, প্রতিদিন মর্গের কাছে এই ভিড়। কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। আসলে বেশির ভাগ বডি গলাপচা অবস্থায় পাওয়া যায়। সনাক্ত করার উপায় থাকে না।
ভিড় সত্যিই বাড়ছিল। দুজন কনস্টেবল, একজন এস আই সেখানে এসে গেলেন। চতুর্বেদী মন্তব্য করলেন, আজকাল পুলিশের কাজের ঝামেলা বড্ড বেশি বেড়ে গেছে।
শর্মা হাসতে হাসতে বললেন, দেশের যা অবস্থা হচ্ছে, এরপর পুলিশের আর কোনো ভূমিকা থাকবে না। মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে।
চতুর্বেদী বললেন, আসলে রাজনৈতিক চাপটা ভীষণ বেশি। দে ইন্টারভেন ইন ইচ অ্যান্ড এভরি কেস। দ্যাটস্ দা রিয়্যাল প্রব্লেম।
কর্নেল বললেন, এক পেয়ালা কফি পেলে ভাল হত।
শর্মা বললেন, কফি! হাসপাতালের ক্যান্টিনের যা অবস্থা, সেখানে কফি পাওয়া গেলেও এক চুমুকেই বমি আসবে। বরং বাইরে গেটের পাশে রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়।
কর্নেল বললেন, আপনারা প্লিজ এখানে অপেক্ষা করুন। যদি আমি না ফিরি, হোটেলে যোগাযোগ করবেন। আপনাদের থাকার দরকার আছে।
দুই অফিসার অবাক। শর্মা বললেন, কী ব্যাপার?
শরীরটা খারাপ বোধ হচ্ছে। কর্নেল আস্তে বললেন। আপনারা শুধু নজর রাখবেন, তপেশবাবুর বডি সনাক্ত করতে বা তার বডি দেখতে কে কে আসছে। তাদের নাম-ঠিকানা জেনে নেবেন। চলি!
দুই অফিসারকে আরও অবাক করে কর্নেল হনহন করে এগিয়ে গেলেন। মোহন শর্মা চাপা স্বরে বললেন; এক পাগলের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি! সুরেশ, এই বুড়ো লোকটার সংসর্গ আমার আর সুবিধের ঠেকছে না। লেট আস প্রসিড ইন আওয়ার ওন ওয়ে।
ইয়া। চতুর্বেদী সায় দিলেন। লিভ হিম। হি ইজ আ ম্যাড ফেলা।…
কর্নেল বারান্দায় উঠেছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের ভেতর দিয়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন। তারপর প্রাঙ্গণ পেরিয়ে গেটের দিকে চললেন।
একটু পরে হাসপাতালের গেটের বাইরে একটা রেস্তোরাঁ দেখতে পেলেন। সাইন বোর্ডে লেখা আছে আজাদ রেস্তোরাঁ। হাথিয়াগড়ে লোকের সাচ্ছল্য বেড়েছে। একটু দূরে খনি অঞ্চল। তাই এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় একেবারে মড পুলিশ। ছিমছাম, সুদৃশ্য, মহার্ঘ।
রেস্তোরাঁর ভেতরে তত ভিড় নেই। মড পোশাক ও চেহারার যুবকেরা, জনাকতক বয়স্ক–চেহারায় বিত্ত ও আভিজাত্যের ছাপ, চা বা কফি খেয়ে শীত দূর করছেন। কোনার দিকে একটি টেবিল খালি ছিল। কর্নেল সেখানে বসে কফি ও পকৌড়ার অর্ডার দিলেন। খিদে পেয়েছিল।
পরপর দু কাপ কফি খেতে আধঘণ্টা কাটল। তারপর ঢুকলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। ফো। মাথায় হনুমান টুপি। পরনে দামী স্যুট। হাতে অ্যাটাচি কেস।
ভেতরে ঢুকেই তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে খালি আসন খুঁজছিলেন যেন। ভিড় কিছুটা বেড়েছে। কর্নেলের চোখে চোখ পড়লে একটু ইতস্তত করলেন। তারপর সোজা এগিয়ে এলেন। এ টেবিলে তিনটে চেয়ার খালি। একটু হেসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, বসতে পারি?
কর্নেল বললেন, নিশ্চয়!
ধন্যবাদ। বলে ভদ্রলোক মুখোমুখি বসলেন। বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরেক কাপ কফি হোক, কর্নেল?
কর্নেল চমকে উঠলেন না। স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। দু পেয়ালা হয়ে গেছে।
বেয়ারাকে কফি, স্যান্ডউইচ ও ডবল ওমলেটের অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোক একটু হাসলেন।…আমার নাম শ্যামলকান্তি মজুমদার। ইলেকট্রনিক গুডসের ব্যবসা করি। কলকাতায় থাকি।
আমাকে আপনি চেনেন?
চিনি। শ্যামলকান্তি বললেন, আপনি প্রখ্যাত মানুষ। আপনাকে চেনে না কে?
কর্নেল চুরুট ধরালেন এতক্ষণে। বললেন, অসংখ্য লোক চেনে না। যাই হোক, কাল সন্ধ্যায় মোতিগঞ্জ স্টেশনে চায়ের স্টলে আপনি বসে ছিলেন। মোতিগঞ্জে কি ব্যবসার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন?
ঠিক ধরেছেন। হাথিয়াগড়েও একই উদ্দেশ্যে এসেছি। বিহারের শিল্পা ভাল মার্কেট আছে। একটু যোগাযোগ করার দরকার ছিল।
করলেন?
করছি। বাই দা বাই, আপনি এই সুইসাইড কেসের নিষ্পত্তি না করে কলকাতা ফিরবেন না?
কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি অনেক খবর রাখেন।
শ্যামলকান্তি জোরে হাসলেন।… আপনি গোয়েন্দা মানুষ। সবকিছুতেই সন্দেহজনক গন্ধ পান। না কর্নেল! আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব প্রাঞ্জল। কোন রহস্য-টহস্য নেই। আপনার চেহারার বর্ণনা আমি খবরের কাগজ এবং জয়ন্ত চৌধুরির লেখা বইতে পড়েছি, তবে কাল মোতিগঞ্জ স্টেশনে আপনাকে দেখে। চিনতে পারিনি। চিনলুম কিছুক্ষণ আগে, যখন পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে মর্গের ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন। মানে, দুইয়ে দুইয়ে যোগ দিয়ে চার করলুম আর কী!