কর্নেল একটু হেসে বললেন, হেঁটেলের ওই ঘরটার চার্জ চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পঁচাত্তর টাকা। এ ছাড়া খাওয়া খরচ আছে। অথচ পেলেন মাত্র পনের টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
মোহন শর্মা ও সুরেশ চতুর্বেদী পরস্পরের দিকে তাকলেন। দুজনেই অগত্যা হাসলেন। চতুর্বেদী বললেন, হ্যাঁ–এটা একটা পয়েন্ট।
মোহন শর্মা বললেন, ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট।
পাশের ঘরে তখন হাসপাতালের দুজন ডোম এসে গেছে স্ট্রেচার নিয়ে। বডি ওঠাচ্ছে। কর্নেল বললেন, এক মিনিট! বলে সুশোভন ওরফে তপেশের মৃতদেহের পিঠের দিকে জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে কী একটা বের করলেন।
সেটা একটা আইডেন্টিটি কার্ড। তাতে এই মৃতেরই ছবি। কার্ডটি পারিজাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির। হেড অফিস কলকাতার একটা ঠিকানায়। শাখা ভারতের বড়-বড় শহরে। কিন্তু মোতিগঞ্জ বা হাথিয়াগড়ে কোন শাখা নেই। কার্ডে লেখা আছে : তপেশ বসাক, রিপ্রেজেন্টেটিভ।
ডাঃ মুখার্জি আবার বলে উঠলেন, রীতিমতো রহস্যজনক! পিঠের দিকে আইডেন্টিটি কার্ড!
কর্নেল বললেন, এটা তত কিছু রহস্যজনক নয়, ডাঃ মুখার্জি! এই চামড়ার জ্যাকেটগুলো সিঙ্গাপুরে তৈরি হয়। পিঠের দিকে ভেতরে একটা পকেট থাকে। আমারও এরকম একটা জ্যাকেট ছিল। যাই হোক, বডি মর্গে চলে যাক। এবার চলুন মিঃ শর্মা, নিচের ডাইনিং হলে গিয়ে এক পেয়ালা করে কড়া কফি খাওয়া যাক। কফি না খেলে আমার মাথা খোলে না।
সিঁড়িতে নামার মুখে ডিটেকটিভ অফিসার চতুর্বেদী বললেন, জামায় রক্তের দাগ ব্যাপারটা খুব জট পাকিয়ে দিয়েছে। আগে ওটার একটা খেই খুঁজে বের করা উচিত। কী বলেন, মিঃ শর্মা? কর্নেল?
কিন্তু এই প্রচণ্ড শীতে গরম কফির চিন্তা শর্মা ও কর্নেলকে ততক্ষণে আবিষ্ট করে ফেলেছে। ওঁরা কোনো জবাবই দিলেন না।…
০৩. শ্যামলকান্তি ও সুভদ্র
কর্নেল যেখানে-সেখানে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারেন–সে জঙ্গলে হোক, কী কুঁড়েঘরে। এমন কী বিপদ-আপদের আশঙ্কার মধ্যেও তাঁর তাক লাগানো ঘুম সম্পর্কে খ্যাতি আছে। অথচ হাথিয়াগড় হোটেলে এ রাতে তিনি ঘুমুতে পারছিলেন না। বারবার মনে একটা দুঃখ চিমটি কাটছিল, জীবনে এই প্রথম তিনি একজন মানুষের মৃত্যুর একান্ত কারণ হয়ে উঠলেন!
শেষ রাতে যদি বা একটু তন্দ্রামতো এল, তাও কেটে গেল। যুবকটির কাছে একটা পিস্তল ছিল। তার মানে যে সে নিজে একজন খুনী, আপাতত প্রমাণ নেই তার। তাছাড়া খুনী কাউকে খুন করে তার রক্তমাখা জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় না। অথচ সে সঙ্গে পিস্তল রাখত।, এ থেকে সিদ্ধান্ত করা চলে,
অস্ত্রটা তার আত্মরক্ষার জন্য দরকার ছিল।
আর ওই প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে দশ হাজার টাকা পাঠানো! হুঁ, টাকা সে সঙ্গে রাখতে সাহস পায়নি। কিন্তু টাকাগুলো কি সে মোতিগঞ্জে পেয়েছিল? কার কাছে পেয়েছিল? কেন পেয়েছিল?
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : পঁচাত্তর টাকা ভাড়ার ঘর বুক করল এই হোটেলে। অথচ পকেটে মাত্র ১৫ টাকা ৫০ পয়সা সম্বল! তাহলে এ হোটেল ভাড়ার টাকা কী করে মেটাত সে?
হুঁ, এই হাথিয়াগড়েও কি কারুর কাছে টাকা পেত? কার কাছে? হাথিয়াগড়ে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের কোনো শাখা নেই। বিহার রাজ্যেই এই কোম্পানির কোনো শাখা নেই। অবশ্য দিল্লি যাওয়ার পথে এখানকার কোন ব্যবসায়ীর মাল পারিজাত কোম্পানির ট্রাকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তা যদি হত, তাহলে তার কাগজপত্রও থাকত। কাজেই হাথিয়াগড়ে কোম্পানির পাওনাকড়ির ভরসায় সে হোটেল ভাড়া করেনি। অন্য কারুর কাছেই টাকা পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা ছিল। নিশ্চিত নয়–সুনিশ্চিত বলা উচিত।
আর ঘুম এল না কর্নেলের। ভোরে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশার মধ্যে, চিরদিনের অভ্যাস মতো, টুপি-ওভারকোট-মাফলার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেলেন। ঘাটের মুখে ঘিঞ্জি বাজার। গরিবগুরবো লোকেরা আগুন জ্বেলে বসে আছে। একটা চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাগিদ দিয়ে এক ভঁড় চা আদায় করলেন চৌগুণ দামে। তারপর গঙ্গার ধারে পিচরাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। এখন তিনি প্রকৃতি-অভিমুখী।
শহরের বাইরে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য উঠল। তখনও ঘন কুয়াশা। পাখি দেখার চেষ্টা করছিলেন বাইনোকুলারে। এত শীতে পাখিরাও বড় কাতর। খড়কুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বসে রইলেন বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ।
ফেরার পথে রিকশা পেয়ে গেলেন। বললেন, হাসপাতাল।
আটটা বাজে। মর্গের কাছে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা এবং ডিটেকটিভ অফিসার সুরেশ চতুর্বেদীর সঙ্গে দেখা হলো। শর্মা বললেন, সাতটায় এসেছি। আপনার পাত্তা নেই।
চতুর্বেদীকে বিরক্ত দেখাচ্ছিল। বললেন, মর্গে নতুন কিছু কি জানার আছে কর্নেল?
কর্নেল বললেন, কিছু বলা যায় না। বাই দা বাই, ডাঃ মুখার্জি কখন আসছেন?
শর্মা ঘড়ি দেখে বললেন, আটটার মধ্যেই আসতে বলেছি। সচরাচর নটায় আসেন উনি।
চতুর্বেদী বললেন, পোস্টমর্টেম হবে–সেটা তো নিয়মই। কিন্তু পোস্টমর্টেমে নতুন কী জানা যাবে, ভাবছেন কর্নেল?
কর্নেল জবাব দিলেন না। টানা বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলেন। পুলিশ অফিসদ্বয় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হতাশা ও বিরক্তির ভাব মুখে ফুটিয়ে তাকে অনুসরণ করলেন। কর্নেল যেখানে দাঁড়ালেন, সেখানে বড় বড় হরফে মর্গ লেখা আছে। একটা কটু গন্ধ ছড়াচ্ছে। শর্মা নাকে রুমাল চেপে বললেন, বরং নিচে ওইটতলায় গিয়ে বসা যাক, আসুন।