কলিং বেল বাজল। কর্নেল বললেন, কে?
আমি কেয়া।
রিভলবার হাতেই দরজা খুললেন কর্নেল। কেয়া ও সৌম্য দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভেতরে এসো। না–এটা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভগবানদাস শেঠের পাঠানো কিলারদের ফেস করার জন্য আমি তৈরি।
দরজা বন্ধ করে দেখলেন সৌম্য হাসছেন। কেয়ার মুখেও ক্ষীণ হাসি।
কর্নেল মুখোমুখি বসে বললেন, না ডার্লিং! হাসির কথা নয়। হি ইজ আ ডেঞ্জারাস ম্যান।
সৌম্যের হাতে একটা ভাঁজকরা খবরের কাগজ। এগিয়ে দিয়ে বললেন, ফার্স্ট পেজ নিউজ। এখানে কলকাতার কাগজ পৌঁছয় চারটের ট্রেনে। পড়ে দেখুন। তাহলে বুঝবেন, কেন হাসছি।
কর্নেল কাগজটা নিলেন। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা। প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড খবর।
ব্রতীন দাশ বরখাস্ত, দল থেকে বহিষ্কৃত
স্টাফ রিপোর্টার : মুখ্যমন্ত্রী সরিৎশেখর বসু মন্ত্রিপরিষদ থেকে সড়ক ও পরিবহন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন দাশকে বরখাস্ত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বহুদিন থেকে বহু দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। দলের এবং মন্ত্রিপরিষদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যবস্থা নিয়েছেন। ব্রতীনবাবুর প্রতিক্রিয়া জানবার জন্য তাঁর বাসভবনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি বর্তমানে নাকি কলকাতার বাইরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত রাত্রে তড়িঘড়ি ডাকা মন্ত্রিসভার এক গোপন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নেন। পরে সাংবাদিকদের জানান। এর আগেই পার্টি থেকে তাঁকে দশ বছরের জন্য বহিষ্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা কারণে তা কার্যকর করা হয়নি। তাঁর নামে ৫২ লক্ষ টাকা নয়ছয় করার একটি অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত হয়েছিল। সম্প্রতি তদন্ত কমিশনের সেই রিপোর্টটি পেশ করার পর পার্টির ভেতর প্রবল দাবি ওঠে, ব্রতীনবাবুকে বরখাস্ত করা হোক। মুখ্যমন্ত্রী অবশেষে এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাইটার্স বিল্ডিংস এবং পুলিশ মহলের একাংশও খুশি।
সৌম্য চৌধুরি হাসতে হাসতে বললেন, বেলুন ফেঁসে গেছে। এখন আমার ধারণা, এমন একটা কিছু আঁচ করেই ব্রতীন নান্নিমাইজির কাছে পুজো দিতে এসেছিল।
কর্নেল কাগজটা রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, হুঁ, বেলুন ফেঁসে যাওয়াই বটে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গদি জিনিসটেই এমন। যতক্ষণ ওতে কেউ চেপে আছে, সে যা খুশি করতে পারে। ব্যুরোক্রাট এবং পুলিশকর্তাদের নানা বখশিসের লোভ দেখিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সে গদিচ্যুত, সেই মুহূর্ত থেকে সে নিতান্ত সাধারণ মানুষ। মাথা ভেঙেও সে ওঁদের সাহায্য পাবে না। আধুনিক গণতন্ত্রের এ একটা সাধারণ নিয়ম বলা যায়। এক্ষেত্রে ব্রতীনবাবু দল থেকেও বহিস্কৃত। এখন পাল্টা দল গড়ার চেষ্টা করতে পারেন। তবে ব্যাপারটা খুর সোজা হবে না। কাগজগুলো এমন কেচ্ছা শুরু করে দেবে, দেখবেন তখন। অতএব এখন ওঁর ভরসা কিছু মস্তান দুবৃত্ত। কিন্তু তা দিয়ে নতুন ইমেজ তৈরি করা অসম্ভব। আমরা জনগণকে যত বোকা ভাবি, তত বোকা নয় তারা। এর প্রমাণ বারবার পাওয়া গেছে।
সৌম্য বললেন, কে যেন বলেছিলেন, ক্ষমতায় ওঠা মানে বাঘের পিঠে চাপা! কোনো কৌশলে চাপা যদি বা যায়, নামলেই বিপদ। বাঘটা খেয়ে ফেলবে। ব্রতীনের দশা দেখতে পাচ্ছি। আই ফিল পিটি ফর হিম।
কর্নেল হোটেলের ইন্টারকম সিস্টেমের ফোনে কফি আর গরম পকৌড়ার অর্ডার দিলেন। তারপর বললেন, বাই দা বাই, ব্রতীনবাবু মোতিগঞ্জে আসছে, কিভাবে খবর পেলেন আপনারা?
সৌম্য চৌধুরী বললেন, আনন্দভিলার মালী-কাম-কেয়ারটেকার রাঘবের সঙ্গে আমাদের গোপন ব্যবস্থা ছিল। সে হাথিয়াগড়ে সংকেতে খবর পাঠাত সুভদ্রের কাছে। সুভদ্র ট্রাংককলে খবর দিত কলকাতা। শ্যামলদা এই অ্যারেঞ্জমেন্ট চালু করেছিল। রাঘব মাসে-মাসে টাকা পেত সুভদ্রের মারফত। সুভদ্র আমাকে পরশু ট্রাংককলে জানিয়েছিল–
সুভদ্র এখন কোথায়?
হাথিয়াগড়ে নিজেদের বাড়িতেই আছে। তার গয়ে হাত দেয় কে? বিহার মুল্লুক বলে কথা।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার রিং ছেড়ে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, একটা পয়েন্ট এখনও আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। রঞ্জন হাথিয়াগড় গিয়েছিল কেম? আমার থিওরি ছিল, সে ওখানে আরও কাউকে হয়তো সুভদ্রকেই ব্ল্যাকমেইল করতে যেত। পরে জানলুম, সুভদ্রও অন্যতম ব্ল্যাকমেইলার। ব্রতীনকে সেও ব্ল্যাকমেইল করে।
করে এসেছে। সুভদ্র একজন কন্ট্রাক্টার। পশ্চিমবঙ্গ-বিহার সীমানা এলাকায় রোড়স্ ডিপার্টের একচ্ছত্র কন্ট্রাক্ট সেই পেয়ে এসেছে এতদিন। ব্রতীন মুখ নিচু করে তার টেন্ডার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু রঞ্জন ১৫ জানুয়ারি হাথিয়াগড়ে গেল কেন?
সৌম্য চৌধুরি সিগারেট জ্বেলে বললেন, বরাবরই তো যেত। আফটার অল উই ওয়্যার ফ্রেন্ডস্। আমি যতবার মোতিগঞ্জ এসেছি, অবশ্য একা আমার সাহস ছিল না শ্যামলদার সঙ্গেই এসেছি। আনন্দভিলায় ব্রতীনের কাছে চা খেয়েছি। কাজ আদায় করে হাথিয়াগড়ে গেছি। তবে রঞ্জন ছিল ডেয়ার ডেভিল। ওর কথা আলাদা। একা চলে আসত। হাথিয়াগড়েও যেত। এবার অবশ্য সে শ্যামলদার সঙ্গে এসেছিল। একসঙ্গে হাথিয়াগড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সে হোটেলে উঠেছিল কেন?
হ্যাঁ, রঞ্জন খুব সাবধানীও ছিল। আমাদের টেক্কা দিয়ে ব্রতীনের কাছে লায়নস শেয়ার সে আদায় করেছে। তাই আমাদের সম্পর্কে তার সাবধান থাকা। স্বাভাবিক। আমরাও যথেষ্ট ঈর্ষা করতুম তাকে। সেও স্বাভাবিক। বাট উই ওয়্যার ফ্রেন্ডস্। আমাদের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়া ছিল।