ব্রতীন দাশ একটা বজরায় গিয়ে ঢুকলেন। বজরাটা ইঞ্জিনচালিত। সোজা ভেসে চলেছে ওপারের ঘাট লক্ষ্য করে।
কর্নেল শ্বাস ছেড়ে ঘুরে আশ্রমের দিকে চললেন। তারপর দেখতে পেলেন, কেয়াকে। বাঁদিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বিস্ময়, হতাশা। আর ক্ষোভের জটিল ছাপ।
কর্নেল ডাকলেন, কেয়া!
কেয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, মাইজির আশ্রমের পুজো দিতে এসেছিলুম।
কর্নেল হাসলেন।…তোমার পুজো ব্যর্থ হয়েছে। ব্রতীন দাশ নিরাপদে চলে গেলেন।
কেয়া এতক্ষণে কর্নেলের হাতের ব্রিফকেসটি লক্ষ্য করলো। চমকে উঠলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ওটা কোথায় পেলেন? ওটা তো—
সে থেমে গেল হঠাৎ। কর্নেল বললেন, ঠিক চিনেছো। এটা সৌম্যবাবুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কারণ বেঁচেবর্তে থাকো এবং ক্ষমা করো, নতুন করে ঘর বাঁধার পথে এই জিনিসটা সাংঘাতিক বাধা হয়ে দাঁড়াতো।
কেয়া ঝরঝর করে কেঁদে ফেলোে।
কর্নেল বললেন, ডার্লিং! আমি প্রফেট নই, মহামানব নই–সামান্য মানুষ। কেঁদো না। মোতিগঞ্জে ফিরে যাও। সৌম্যকে বলেছি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে। একটু পরে পুজো শেষ হলে যাত্রীরা ঘাটে ফিরবে। সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে হোটেল পারিজাতে দেখা করো। সৌম্যকে নিয়ে যেও। অবশ্যই যেও।
কেয়া চোখ মুছে বলল, ব্রতীনের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন!
হুঁ, বলছিলুম। আমাকে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে দেখা করতে বলল। আনন্দভিলাতে?
হ্যাঁ। আনন্দভিলাতে। মোতিগঞ্জে ওই ভিলার মালিক ভগবানদাস শেঠ। যাই হোক, ডোন্ট ওরি! ঘাটে যাও। ওই বোধ করি পুজো শেষ হলো।
কর্নেল আশ্রমের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফটক দিয়ে ভক্তরা বেরিয়ে আসছে।…
উপসংহার
কর্নেলের ভাড়া করা নৌকোর মাঝিরা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল। সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। কিছুদূর উজিয়ে গিয়ে নৌকো ভাটির মুখে কোনাকুনি ভেসে চলল। কর্নেল ছইয়ে উঠে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। সৌম্যের ব্রিফকেসটা ছইয়ের ওপর রাখলে হালের মাঝি হুঁশিয়ারি দিল, গির যায়েগা সাব! হোশিয়ারি সে রাখিয়ে।
ব্যস, অমনি ছই গড়িয়ে ভারি ব্রিফকেসটা মাঝগঙ্গায় পড়ে তলিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ওই যাঃ!
মাঝিরা হইচই করে উঠলো। হালের মাঝি বলল, হাম বোলা গির যায়ে গা! হায় রামজি! রুপে-উপেয়া কেত্তা তা সাব?
কর্নেল নির্লিপ্তমুখে বললেন, কুছ নেহি! কাপড়-উপড়া থা কুছ! ছোড়!
মনে মনে হাসছিলেন। ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছেন। বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র। কোথায় পেলেন, পুলিশকে বলা যাবে না। কাজেই বিসর্জন দেওয়ার দরকার ছিল।
হোটেল পারিজাতে ফিরতে একটা বাজলো। লবিতে সুরেশ চতুর্বেদী অপেক্ষা করছিলেন। মুখটা গম্ভীর। কর্নেলকে দেখে উঠে এলেন। কর্নেল বললেন, ভেরি সরি মিঃ চতুর্বেদী! ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ওপারে নান্নিমাইজির আশ্রমে চলে গিয়েছিলুম।
চতুর্বেদী ঘড়ি দেখে বললেন, আমিও খুব দুঃখিত, কর্নেল। কোনো পাত্তা করতে পারিনি। লোক্যাল পুলিশ, আই বি–কেউ কিছু বলতে পারলো না। দেড়টা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। আমাকে যেতে হবে।
ঠিক আছে। আসুন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
চতুর্বেদী ধন্যবাদের অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
স্নান এবং খাওয়ার পর কর্নেল কিছুক্ষণ পুবের ব্যালকনিতে চুপ-চাপ বসে চুরুট টানতে টানতে গায়ে রোদ্দুর নেবার চেষ্টা করছিলেন। রোদ্দুরটা দ্রুত সরে গেল অন্য ব্যালকনিতে। তখন ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। যাবেন ব্রতীন দাশ ওরফে ভগবানদাস শেঠের আনন্দভিলায়? যাওয়াটা কি নিরাপদ হবে? পুরস্কৃত হওয়ার নানারকম অর্থ করা যায়। মৃত্যুও পুরস্কার হয়ে উঠতে পারে। যতটুকু বুঝেছেন, অতি জটিল ও কুটিল চরিত্রের লোক ব্রতীন দাশ। এক সময় সে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারতো। গোপনে ধর্মকর্ম করে। কিন্তু বাইরে মার্কসবাদী। হুঁ, মনে-মনে ভেঙে না পড়লে এমনটা কেউ করে না। তার চেয়ে বড় কথা, সে একজন ক্ষমতালোভী মানুষ। এ ধরনের মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। কর্নেলকে নিজের ডেরায় পেয়ে যদি সুশোভনের মতোই খতম করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়, কেউ টের পাবে না। সুশোভনের বেলায় সাক্ষী ছিল। এখানে সাক্ষী থাকবে না।
নাঃ, যাওয়া উচিত হবে না। কর্নেল পুবের জানলার ধারে গেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে দুরে গঙ্গার একটা চরের পাশে হাঁস দেখতে থাকলেন। এ বেলা আর হোটেল থেকে বেরুচ্ছেন না। অনেক কিছু ভাবতে হবে। কেয়ার মুখটা বারবার মনে ভেসে আসছে। কিন্তু কী ভাবে তার ঘর বাঁধার সাধ মেটাতে সাহায্য করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। সৌম্য বিমলকুমারকে খুন করেননি বলেছেন। করেছেন শ্যামলকান্তি। তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শ্যামলকান্তি শাস্তি পেলে কর্নেল বরং খুশিই হবেন। সুভদ্র বিহারের ছেলে। তার বাবা বড়লোক জমিদার। তাকে বাঁচাতে পারবেন তিনি। বিহারের প্রশাসন তো…। শুধু সৌম্য চৌধুরীকে বাঁচানো সমস্যা। একজন মন্ত্রী তার শত্রু। সৌম্য রক্ষা পেলে কেয়া তাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। তপেশ বসাকের রাখা টাকা ব্যাংক কেয়াকে দিতে আইনত বাধ্য। সে টাকায় পাপ কিসের? তার দাদার জীবনের মূল্য পরিশোধ করেছে ব্রতীন।…
পাঁচটাতেই সন্ধ্যা এসে গেল। গঙ্গার ওপর তখন ঘন কুয়াশা। আজ ঠাণ্ডাটা বেড়েছে। ঘরে বসে কফি খাচ্ছিলেন কর্নেল। দরজা বন্ধ। রিভলবার হাতের কাছে রেডি। দেখা করতে যাননি বলে ব্রতীন একজন আততায়ীকেও পাঠাতেও। পারে। সতর্ক থাকা দরকার।