সৌম্য চৌধুরি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে হরি শুধু পাপীদেরই বাঁচান, সে হরিতে আমার বিশ্বাস নেই। ওসব বোগাস থিওরি আওড়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না। প্লিজ। ওটা ফেরত দিন।
কর্নেল কথায় কান দিলেন না। বললেন, আপনারা কোথায় উঠেছেন সৌম্যবাবু?
বলবো না।
শুনুন, মোতিগঞ্জে যেখানে উঠেছেন, সেখানে ফিরে যান। অপেক্ষা করুন। কেয়ার সঙ্গে আমি আশ্রমে দেখা করছি। তাকে বলবো, আপনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। লেট মি ফেস ব্রতীনবাবু। আমি ওঁর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবো।
পারবেন না। ওর সঙ্গে দুজন বডিগার্ড আছে, দুই কুখ্যাত মস্তান।
কর্নেল ব্রিফকেস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চেষ্টা করা যাক। আপনি আর এখানে থাকবেন না। নৌকো পেয়ে যাবেন ঘাটে। চলে যান–শিগগির!
সৌম্য চৌধুরি হিংস্র, হতাশ, অসহায় দুষ্টে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছেন টিলা থেকে। এক হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে রিভলবার।…
২০. মুখোমুখি
কর্নেল মোরামঢাকা রাস্তায় এগিয়ে আশ্রমের ফটকের সামান্য দূরে একটা আকাশিয়া গাছের তলায় অপেক্ষা করছিলেন। হাতে সৌম্যের সেই মারাত্মক ব্রিফকেস। গলা থেকে ঝুলন্ত বাইনোকুলারে মাঝে মাঝে পাখি দেখছিলেন। শীতকাতুরে পাখিরা ডাকাডাকি করছিল গাছের পাতার আড়াল থেকে। আশ্রমের ভেতর থেকে খোল করতাল আর গানের চাপা শব্দ ভেসে আসছিল।
কিছুক্ষণ পরে তিনজন লোক বেরিয়ে এলো আশ্রমের ফটক দিয়ে। সামনে একজন, পেছনে দুজন। সামনের জনের পরনে পট্টবস্ত্র, খালি পা, গায়ে উত্তরীয় জড়ানো, নাদুস নুদুস বেঁটে গড়ন, কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, ফর্সা রঙ, সামান্য গোঁফ আছে। পেছনের দুজনের পরনে প্যান্ট, সোয়েটার, চেহারায় উদ্ধত হাবভাব। একজন লম্বাটে রোগা, অন্যজন শক্তসমর্থ গড়নের লোক। চোখের চাউনি চঞ্চল। চিতাবাঘের মতো।
কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখার ভান করলেন। তাকে ট্যুরিস্ট বলেই মনে হবে লোকের। কাঁধে একটা ক্যামেরাও ঝুলছে। একহাতে ব্রিফকেস।
ওরা কাছে এলে কর্নেল রাস্তার মধ্যিখানে গিয়ে পট্টবস্ত্রপরা ভদ্রলোকের উদ্দেশে করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, নমস্কার স্যার!
ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। পেছনের লোকদুটি দুপা এগিয়ে এলো। ভদ্রলোক কপালে একটা হাত ঠেকালেন মাত্র।
কর্নেল বললেন, পুজো দিতে গিয়েছিলেন ব্রতীনবাবু?
ভদ্রলোক চমকে উঠে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।…ক্যা বোস্তা আপ? কৌন ব্রতীনবাবু?
ব্রতীনবাবু, আপনাকে আমি চিনি।…কর্নেল হাসলেন। পশ্চিমবঙ্গের রোড়স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন্দ্রনাথ দাশকে কে না চেনে? কত ছবি বেরোয় কাগজে!
ভদ্রলোক ডাইনে-বাঁয়ে তাকালেন। দেহরক্ষীদ্বয় সামনে এসে বলল, এই বুড়ো! ঝুটঝামেলা কোরো না। কেটে পড়ো বলছি!
কর্নেল একই সুরে বললেন, এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই ব্রতীনবাবু। ধর্মে ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকতেই পারে। বিশেষ করে সঙ্কটে পড়লে মানুষমাত্রই দুর্বল হয়ে যায়।
ভদ্রলোক ফোঁস করে উঠলেন।…ক্যা বোলতা হ্যাঁয় জি? হাম ভগবানদাস শেঠ। আপ ভুল করতা।
সরি ব্রতীনবাবু, আপনার হিন্দি উচ্চারণ আর ভুল টেক্সট্ বলে দিচ্ছে আপনি বাঙালি।
দেহরক্ষীদ্বয় কর্নেলকে ঠেলে সরিয়ে দিল। কর্নেল বাধা দিলেন না। দলটা এগিয়ে চলল। কর্নেল অনুসরণ করে বললেন, ব্রতীনবাবু, আপনি এখনও নিরাপদ নন। সৌম্য চৌধুরি এবং সুভদ্র সিং ধরা পড়েনি। তাছাড়া এটা সুভদ্র সিং-এর এলাকা।
পট্টবস্ত্রধারী ঘুরে দাঁড়ালেন। একজন দেহরক্ষী–যে লম্বা ও রোগা, একটা ড্যাগার বের করলো। পট্টবস্ত্রধারী ইশারায় তাকে নিষেধ করে বললেন, আর য়। ফ্রম এনি সেন্ট্রাল এজেন্সি–সি বি আই আর র?
না ব্ৰতীনবাবু।
দেন আর য়ু আ রিপোর্টার?
কর্নেল একটু হাসলেন শুধু।
ফ্রম হুইচ পেপার?
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।
মিট মি ইন ক্যালকাটা।
ঘুষ দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করতে চান ব্রতীনবাবু? দিস ইজ দা হিউম্যান সাইকলজি। যে একবার জীবনে ব্ল্যাকমেই হয়, সে সবসময় সবকিছুতেই ব্ল্যাকমেইল্ড হওয়ার প্রবণতায় ভোগে। হি সারেন্ডারস্ হিমসেল ইভ টু দা ইমাজিনারি ব্ল্যাকমেইল। যাকে দেখে, তাকেই ভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছে। না স্যার, এভাবে বাঁচা সত্যিই কষ্টকর।
ব্রতীন দাশ আস্তে বললেন, কে আপনি?
আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
ব্রতীন ভুরু কুঁচকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। তারপর বাঁকা হেসে বললেন, ই-বুঝেছি। সামবডি ইন দা পোলিস্–কে যেন আপনার কথা বলেছিল। য়ু আর দা প্রাইভেট ডিটেকটিভ!
ফিল্মের নেগেটিভটা আশা করি নষ্ট করে ফেলেছেন, ব্রতীনবাবু?
ব্রতীন তাকিয়ে রইলেন। এখন মুখের ভাব নির্বিকার।
কিন্তু সৌম্য চৌধুরি আর সুভদ্র সিং ধরা পড়েনি। মাইন্ড দ্যাট!
দ্যাট ইউ টোল্ড মি। ডোন্ট রিপিটু। বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন ব্রতনি। তারপর বললেন, প্লিজ মিট মি ইন দা আফটারনুন বাই থ্রি টু ফোর ও ক্লক।
কোথায়?
অ্যাট আনন্দভিলা।
কর্নেল একটু হাসলেন।…পুরস্কৃত করবেন কি?
ব্রতীনও হাসলেন।..হোয়াই নট? আফটার অল, ইউ হ্যাঁফ সে মি ফ্রম দা ডার্টি র্যাকেট–আইদার উইলিংলি অর আন উইলিংলি, ইউ হ্যাঁভ সেভড় মি। আই মাস্ট গিভ য়ু মাই থ্যাংকস্।
ব্রতীন দাশ হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন ঘাটের দিকে। কর্নেল দাঁড়িয়ে রইলেন। কথাটা ঠিক। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক, প্রকারান্তরে ব্রতীন দাশকে কর্নেলই ব্ল্যাকমেলারদের চক্র থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন তো বটেই! ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় স্যুটকেস বদলের ঘটনাটি না ঘটালে ব্রতীন দাশ নিষ্কৃতি পেতেন না রঞ্জনদের হাত থেকে।