শ্যামলদা কেন ছবি তুলেছিল, গোপনে কেন ক্যামেরা এনেছিল–এসব কিছু জানতুম না আমরা। গিয়ে অপেক্ষা করছি। ব্রতীন রেডি। সুশোভন এলো দেরি করে। তখন রাত আটটা-সওয়া আটটা বাজে। শ্যামলদা বলল, সুশোভন, ওই জানলার কাছে দাঁড়াও তুমি। লক্ষ্য রাখো। বিমল, তুমি দরজার ওদিকটায় যাও।…যাইহোক, খুব ঝটপট নির্দেশ। সুশোভন পুবের পুরনো আমলের গরাদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডোতে একটু ঝুঁকেছে, ব্রতীন আচমকা ওর পিঠে হার্টের দিকে ড্যাগার বসিয়ে দিল। সুশোভন পড়ে গেল। গাঁক করে একটা শব্দ বেরুল ওর মুখ থেকে। ব্যস, খতম! কিন্তু সেই সময় শ্যামলদার হাতে ক্যামেরা এবং ফ্ল্যাশবাল্বে ঝিলিক। এক সেকেন্ড। তারপর ছোট্ট ক্যামেরা শ্যামলদার কোটের ভেতর ঢুকে গেল। সে আমাদের চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ব্রতীন তখন সুশোভনের পিঠে পা চেপে ড্যাগারটা তোলার চেষ্টা করছিল। ছবি তোলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। ড্যাগার তোলার সময় শ্যামলদা তাকে বাধা দিল। বলল, ড্যাগার তুললে রক্ত বেরিয়ে আসবে। এখন নয়। একটু পরে বডিটা ব্রতীনের ভিন্টেজ কারে ঢোকানো হল। রঞ্জন, শ্যামলদা আর ব্রতীন গেল লাস ফেলতে। ওরা ফিরে এলো রাত দশটায়। কোনো রেললাইনে ফেলে এসেছে শুনলাম।
রঞ্জনও ফিরে এলো?
সৌম্য তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো! মনে পড়ছে, রঞ্জন ফেরেনি। শ্যামলদা বলল, রঞ্জনের শরীর খারাপ করছিল। চলে গেছে। তারাও কেটে পড়। দেখি, রক্ত-টক্ত কতটা পড়েছে। সাফ করতে হবে।
রঞ্জন সুশোভনের পরনের কাপড় সংগ্রহের জন্য একটা অছিলা করে চলে গিয়েছিল!
কর্নেলের মন্তব্য শুনে সৌম্য বললেন, দ্যাটস রাইট।
বেশ। তারপর?
তারপর আর কী? পরে পুলিশের চাপে স্কোয়াড ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিপ্লব সম্পর্কে আমাদের মোহও খতম হয়ে গেল। যে-যার নিজের জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলুম।
হ্যাঁ, কিন্তু সুশোভনকে খুন করার কতদিন পরে আপনারা শ্যামলবাবুর বাড়িতে গেলেন এবং রঞ্জন ফিল্ম ছিনতাই করলো?
পরদিন বিকেলে। শ্যামলদাই ব্রতীন বাদে আমাদের সবাইকে তার বাড়িতে যেতে বলেছিল।
ব্রতীনবাবুকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা কখন আপনাদের মাথায় আসে?
শ্যামলদা ছবি প্রিন্ট করার সময় হঠাৎ কথাটা তোলে। বলে বড়লোকের ছেলে ব্রতীনই আসলে শোধনবাদীদের এজেন্ট। ওর শ্রেণীচরিত্র যাবে কোথায়? তাই ওকে একজন কমরেডের জীবনের মূল্যের বিনিময়ে ফঁদে আটকে রাখা হয়েছে। এই ছবি সেই ফাঁদ।
কর্নেল চুরুট ধরালেন–সাবধানে। হাতে গুলিভরা অটোমেটিক রিভলবার তৈরি। একটু দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রতীনবাবু মাইজির ভক্ত। পুজো দিয়ে ফেরার পথে তাকে আপনি গুলি করতেন। কিন্তু তাতে কি হতো? কেয়াকে নিয়ে আপনি ঘর বাঁধতে পারতেন কি? আপনি একটা খুনের কেসের আসামী। আরও একটা বড় খুনের কেসেরও আসামী হতেন। একজন মন্ত্রীকে খুন করা– মাইন্ড দ্যাট! কেয়াও বিপদে পড়তো। না সৌম্যবাবু, এভাবে বাঁচা যায় না।
কীভাবে বাঁচা যায়?
সেদিন গে ক্লাবে যখন গেলুম, তখন এ প্রশ্ন করলে নিশ্চয় জবাব দিতে পারতুম। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, সৌম্যবাবু! আমি দুঃখিত।
সৌম্য ভুরু কুঁচকে বললেন, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন?
হু অ্যাম আই? কর্নেল হাসলেন। আমি কি পুলিশ?
তাহলে কেন আপনি এতে নাক গলালেন?
কর্নেল আস্তে বললেন, রঞ্জনের আত্মহত্যার জন্য নিজেকে দায়ী করেছি।
লেনেয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলবাবু তাঁর কাছে করে থাকবেনজির
সেই পাপবোধের দায়ে এতদূর এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, সৌম্যবাবু! তবে। আমার চিরদিনকার এই এক নেশা, গোপন সত্যকে আবিষ্কার।
করলেন?
করলুম।
তাহলে এবার আপনাকে অনুরোধ করবো, সরে যান। আমার কাজ আমাকে। করতে দিন।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ব্রতীনবাবু মোতিগঞ্জে গোপনে যাতায়াত করেন। পুলিশকে কিছু জানান না। এইটে আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছিল। কেন এমন করেন? ব্ল্যাকমেলারদের সঙ্গে রফা করতেই কি? কিন্তু তা তো নয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলাররা তার এই গোপন ডেরার খবর জানতো। গত ১৫ জানুয়ারি রঞ্জন এবং শ্যামলবাবু তার কাছে এসেছিলেন। রঞ্জন দশ হাজার টাকা আদায় করেছিল। শ্যামলকান্তিও কিছু আদায় করে থাকবেন–হয়তো নট ইন ক্যাশ বাট ইন কাইন্ডস্। এবার বুঝলুম, ব্রতীনবাবু আসলে এই মাইজির আশ্রমে পুজো দিতে আসেন।
সৌম্য চৌধুরি বিকৃত মুখে বললেন, ব্রতীনের কমিউনিস্ট ইমেজ আছে দেশে। মার্কসবাদ নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করে জনসভায়। তাকে এভাবে গোপনেই ধম্মকম্ম করতে হবে। বুর্জোয়া সংস্কার যাবে কোথায়? তাছাড়া সে মানুষ খুন করেছে। পেছনে ব্ল্যাকমেলার লেগে আছে। নানিমাইজি যদি আলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে তাকে বাঁচায়, তবেই নিষ্কৃতি।
কর্নেল হাসলেন।…নানিমাইজির কৃপায় সেই-নিষ্কৃতি অবশেষে মিলেছেও বটে!
বোগাস! আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।
আপনি বিশ্বাস না করলেও ব্রতীনবাবু করেন। সুতরাং ব্ল্যাকমেলারদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এবং তাদের ঢিট করতে পেরে তিনি এবার মাইজির কাছে বড় রকমের পুজো দিতে এসেছেন। কর্নেল হাসতে লাগলেন।…তারপর দেখুন, তাঁকে আপনি মার্কিন আততায়ীদের পদ্ধতিতে দুরপাল্লার এই শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে হত্যা করতে চেয়েছিলেন–পারলেন না! হুঁ, সবই মাইজির কৃপা সৌম্যবাবু! কথায় বলে, রাখে হরি মারে কে?