মাত্র একটা কপি। সেটা শ্যামলদার কাছেই ছিল।
কার ক্যামেরায় দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল?
শ্যামলদার।
পরে ফিল্মটা কীভাবে রঞ্জনের হাতে গেল?
ছবিটা প্রিন্ট করার সময় রঞ্জন, আমি, সুভদ্র, বিমল সবাই শ্যামলদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলুম। শ্যামলদার ক্যামেরার হবি ছিল। নিজেই ডেভালাপ এবং প্রিন্ট করতো। ওর ফ্ল্যাটে একটা ডার্করুম ছিল।… সৌম্য চৌধুরী শাস ছেড়ে বললেন ফের, প্রিন্টটা তখনও জলে ভর্তি ট্রেতে আছে। ফিল্মটা শ্যামলদা কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়েছিল আলাদা করে। সেটা তখন ওর হাতে। হঠাৎ পিস্তল বের করে রঞ্জন নেগেটিভটা শ্যামলদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলুম রঞ্জন পিস্তল তুলে সবাইকে শাসিয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর রঞ্জনের সঙ্গে আপনাদের বোঝাঁপড়া হয়েছিল? শ্যামলদার মারফত হয়েছিল। তারপর সুভদ্রের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয় রঞ্জনের।
হুঁ, শ্যামলবাবু সেই প্রিন্টটার সাহায্যে খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। কিন্তু আপনারা–
বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাছাড়া আমরা যখন ব্রতীনের কাছে যেতুম, দল বেঁধেই যেতুম। আমি, শ্যামলদা, সুভদ্র আর বিমল। রঞ্জন প্রথম-প্রথম আলাদাভাবে একলা যেতো ব্রতীনের কাছে।
কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, রোড়স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টসের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন দাশ?
হ্যাঁ। ভণ্ড। খুনী। বিশ্বাসঘাতক।
শ্যামলবাবুর প্রিন্টটা সম্পর্কে কিছু জানেন, সৌম্যবাবু?
ও একটা নির্বোধ। ওকে অ্যারেস্ট করার সময় প্রিন্টটা ওর কাছেই থাকা সম্ভব। কারণ সবসময় ওটা তার কাছেই থাকত। কাজেই পুলিশ ওটা যথাস্থানে দিয়ে থাকবে এবং এখন নিশ্চয় তা ছাই হয়ে গেছে। তবে নেগেটিভটা রঞ্জনের কাছে ছিল। সেটার কী হয়েছে জানি না। নাকেয়াকেও রঞ্জন ওটা দেয়ান। কেয়া জানে না ওটা কোথায় আছে।
ব্রতীনবাবু নেগেটিভটাও হাতিয়ে নিয়েছেন।
সৌম্য চৌধুরি তাকালেন। আস্তে বললেন, আর য়ু সিওর?
সিওর। বলে কর্নেল সাবধানে, চোখ সৌম্যের দিকে রেখে রাইফেলটার পাটস খুলতে শুরু করলেন। খোলা হলে বললেন, প্লিজ, ব্রিফকেসটা দিন। আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে।
সৌম্য ব্রিফকেসটা এগিয়ে দিলেন। মুখে অসহায় ও হতাশ ভাব।
কর্নেল পার্টসগুলো ব্রিফকেসে ভরে বুলেটগুলো দেখে নিলেন। ৩০৩ বুলেট। বিদেশী। ব্রিফকেস বগলদাবা করে একটু হেসে বললেন, এটা কোথায় যোগাড় করলেন সৌম্যবাবু?
এটা সুভদ্রের। বিহারে বড়লোক-জমিদার-জোতদারের ঘরে এসব জিনিসের অভাব নেই।
হুঁ, সুভদ্রও ব্রতীনবাবুর মৃত্যু চায়।
খুব স্বাভাবিক। বিমলকে খুনের অন্যতম আসামী সেও।
সুশোভনকে ব্রতীনবাবু কেন খুন করেছিলেন মিঃ চৌধুরি?
সৌম্য একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বললেন, দ্যাটস আ লং স্টোরি।
সংক্ষেপে বলুন।
সৌম্য হাঁটু মুড়ে বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, প্রায় এগারো বছর আগের কথা। সুশোভন, আমি, রঞ্জন, সুব্রত, সুভদ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র তখনও। আমরা লিন পিয়াওপন্থী গ্রুপের অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলুম। শ্যামলদা তখন আমাদের অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা। পরে ব্রতীন এই স্কোয়াডে আসে–ও স্কটিশে পড়তো। ওকে পাঠানো হয় আমাদের স্কোয়াডে। ওর প্রতি আমাদের প্রত্যেকের সন্দেহ ছিল। তবে কিছু করার ছিল না। উই ওয়্যার নাটবোপ্টস্ অফ আ মেসিন। এভাবেই স্কোয়াড গড়া হয়েছিল। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলা চলবে না। ওপর থেকে যে নির্দেশ আসবে, তা পালন করতে হবে। নয়তো মরতে হবে। নির্দেশ আসতো শ্যামলদার মারফত।
সৌম্য ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, পরে সব বুঝেছিলাম–তখন বুঝিনি। সুশোভন একটু চঞ্চল এবং সন্দেহপরায়ণ ছেলে ছিল। ব্রতীনকে সে ভাল চোখে দেখতো না। আড়ালে আমাদের বলতো, ব্রতীন আসলে কারুর এজেন্ট। ওকে আমরা পাত্তা দিতুম না। তাছাড়া ডিসিপ্লিন ছিল কড়া। আমাদের স্কোয়াডে মোট বারোজন ছেলেমেয়ে ছিল। হঠাৎ একদিন চারজন ধরা পড়ল এবং নিখোঁজ হয়ে গেল। তখন বিমল শ্যামবাজারে থাকতো। সিনেমার পোস্টার আর সাইনবোর্ড আঁকতো–এটা তার বাইরের পরিচয়, এবং সে পড়াশুনা ছেড়ে চলে এসেছে। তার ঘরে আমাদের গোপন বৈঠক হলো। ব্রতীনও ছিল সেখানে। সুশোভন তাকে সোজা চার্জ করলো। ব্রতীন পাল্টা চার্জ করলো ওকে। ব্যাপারটা সেদিনকার মতো মিটে গেল। কদিন পরে সুশোভনকে না জানিয়ে বৈঠক হলো। শ্যামলদা বলল, সুশোভনই পুলিশের এজেন্ট। নির্দেশ এসেছে, ওকে খতম করতে হবে। ব্রতীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাকে কাজটা দেওয়া হোক। পরের বৈঠক ব্রতীনের বাড়িতে। ওরা ময়মনসিংহের এক প্রাক্তন জমিদার ফ্যামিলি। বিশাল বাড়ি। খানিকটা সরকার দখল করেছিলেন। কিছু অংশে ভাড়াটে ছিল। ব্রতীনের বাবা-মা-ভাইবোনেরা টালিগঞ্জে নতুন বাড়িতে থাকতেন। ব্রতীন একা পুরনো বাড়িটার দোতলার একটা অংশে থাকতো। সেখানেও আমাদের বার দু তিন বৈঠক হয়েছে। এবার বৈঠক বসল–মানে সুশোভনকে খতম করার একটা কৌশল সেটা ব্ৰতীনের ঘরে। বিশাল বাড়ি। ভেতরে পুকুর, বাগান, ঠাকুরদালান এসব আছে। ব্রতীনের ঘরে কিছু ঘটলে বাইরের কেউ টের পাবে না। সবচেয়ে সুবিধা, ওর একটা ভিন্টেজ কারও ছিল। বড়লোকের ছেলের হবি আর কী!
সৌম্য চুপ করলে কর্নেল বললেন, হুঁ– তারপর?