যানে কা নাও মিলেগা ইধার?
জরুর! উও দেখিয়ে! কুছু জাস্তি দেনেসে লে যায়ে গা।
একটা ছোট্ট নৌকোর মাঝি দাঁও বুঝে যাতায়াতের ভাড়া চল্লিশ রুপেয়া হাঁকলো। কর্নেল রাজি। বললেন, জলদি যানে পড়েগা! বহত জলদি! ঔর পাঁচ বখশিস মিলেগা। সমঝা?
নৌকোর হালে এক মাঝি, বৈঠায় দুজন। ছইয়ের ভেতর বসে কর্নেল বাইনোকুলারে সেই যাত্রীবাহী খোলা নৌকোটা দেখতে থাকলেন। সৌম্য ও কেয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেয়ার কাঁধে একটা ব্যাগ, সৌম্যর হাতে ব্রিফকেস। ওদের নৌকো যখন ঘাটে পৌঁছুল, তখন কর্নেল মাঝনদীতে। তার তাড়ায় বৈঠার মাঝিরা দ্রুত বৈঠা মারছিল।
শক্তিশালী দূরবীন যন্ত্রটিতে (যা আধুনিক পরিভাষায় বাইনোকুলার) ঘাট থেকে যাত্রীদের নেমে গাছপালার ভেতর এক ফালি মোরাম বাঁধানো রাস্তায় ভক্তিভরে হাঁটতে দেখা যাচ্ছিল। আশ্রমের ফটক পর্যন্ত দৃষ্টি যায় এখান থেকে। সৌম্য ও কেয়া পিছিয়ে হাঁটছে। সব যাত্রী আশ্রমে গিয়ে ঢুকলে দুজনে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল। তারপর কর্নেল দেখলেন, ব্রিফকেস হাতে সৌম্য দ্রুত বাঁদিকে ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়লেন। কেয়া আশ্রমের ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।
কর্নেল ফের তাড়া দিলেন মাঝিদের। হালের মাঝি হেসে বলল, আবৃতি আভি দের হ্যাঁয় সাব! মাইজি আভি ধ্যানমে। ধ্যানকা বাদ পূজা।
ঘাটে তিনটে বজরা এবং আরও কিছু ছই নৌকো বাঁধা। মাঝিদের অপেক্ষা করতে বলে কর্নেল মোরাম ঢাকা রাস্তায় হাঁটতে থাকলেন। আশ্রমের ফটকের কাছাকাছি গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলেন। জঙ্গলে ঢাকা একটা টিলা উঠে গেছে। বড় বড় পাথর পড়ে আছে জঙ্গলের ভেতর। এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিঃশব্দে টিলা বেয়ে উঠতে থাকলেন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে নিচের জঙ্গলের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। কোথায় সৌম্য?
টিলার চূড়ার কাছাকাছি একটা ঝাকড়া বটগাছ। সেখানে পৌঁছে আবার বাইনোকুলারে সৌম্যকে খুঁজতে থাকলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা নিচে ডানদিকে পাথরের একটুকরো চাতাল এবং চাতালের কিনারায় ঘন ঝোঁপের মাথায় একটু ধোঁয়া, সিগারেটেরই ধোঁয়া, অথচ বাইনোকুলারের লেন্সে তা এক ঝক কুয়াশা হয়ে উঠেছে। বাতাসে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল, আবার উপচে উঠল, আবার ভেঙে মিলিয়ে গেল। কর্নেল সাবধানে গুঁড়ি মেরে নামতে থাকলেন।
চাতাল থেকে মোরাম ঢাকা রাস্তাটা। আন্দাজ দুশো মিটার দূরে এবং একটু ডাইনে ঘাটটাও প্রায় সমান দূরত্বে। চাতালটাকে একটা সমকোণী ত্রিভুজের একটা কোণ ধরলে দূরত্ব তাই দাঁড়ায়। এখানে লুকিয়ে কী করছেন সৌম্য চৌধুরী?
একটা বড় পাথরের ফাঁকে উঁকি মেরে ফুট বিশেক দূরে দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠলেন কর্নেল।
সৌম্য ব্রিফকেস খুলেছেন। ঠোঁটে সিগারেট। পরনে ছাইরঙা জ্যাকেট, জিনস। হাঁটু দুমড়ে বসে কী একটা যন্ত্রের পার্টস জোড়া দিচ্ছেন।
একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল এবং নলের ডগায় টেলিলেন্স! সিগারেট ঘষটে নিভিয়ে গুঁড়ো করে ফেলে দিলেন সৌম্য চৌধুরী। রাইফেলটা তুলে নলটা ঘুরিয়ে টেলিলেন্সটা অ্যাডজাস্ট করলেন। তারপর পাশে রেখে দিলেন। ঝোঁপের ছায়ায় সরে বসলেন।
একটু পরে দ্রুত পিছু ফিরে কর্নেলকে দেখেই রাইফেলটা তুলতে চেষ্টা করলেন। কর্নেলের হাতে রিভলবার। কঠিন মুখে কর্নেল বললেন, ওটা রেখে দিন সৌম্যবাবু! প্রয়োজনে মানুষের হাত ভেঙে দিতে আমি দ্বিধা করি না।
সৌম্য চৌধুরী হিংস্র দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
কর্নেল নেমে এসে রাইফেলটা তুলে নিয়ে একটু তফাতে বসে পড়লেন। বললেন, তিনি আশ্রমে পুজো দিতে এসেছেন এবং ফেরার পথে তাকে
বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, ও একটা ভণ্ড। মুখে বলে, ধর্ম জনগণের আফিং। কিন্তু গোপনে ধর্মের পায়ে মাথা ভাঙে।
সেটাই তাকে আপনার খতমের চেষ্টার কারণ নয় সৌম্যবাবু! কর্নেল একটু হাসলেন। আপনি আদর্শের জন্য খতম করতে আসেননি। এসেছেন দুটো কারণে। পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে বোঝা-পড়ার তাগিদে এবং নিজের প্রতিহিংসা মেটাতে।
সৌম্য চুপ করে থাকলেন। মুখটা নিচু। কর্নেল বললেন, এটা ঠিকই যে, কেয়া আপনার কাছে প্রেমের বদলে তার দাদার অসহায় মৃত্যুর প্রতিশোধ দাবি করতেই পারে এবং আপনিও প্রতিহিংসায় খেপে উঠতেই পারেন। লোকটা শ্যামলকান্তিকে ধরিয়ে দিয়েছে। আপনাকেও ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কারণ এবার আপনাদের ব্ল্যাকমেলিং থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ মিলেছে তার। কিন্তু সে-সুযোগ আপনারাই তাকে দিয়েছেন। বিমলকুমারকে খুন না করলে–
সৌম্য দ্রুত বললেন, আমি না ওই শুওয়েরর বাচ্চা শ্যামলদা! আমি নিষেধ করেছিলুম। শোনেনি। বলেছিল, বিমলের মুখ বন্ধ না করলে নাকি আমরা বিপদে পড়বো। ওকে আর ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।
হুঁ, বিমলবাবুর মধ্যে ইনস্যানিটির লক্ষণ দেখেছিলুম। কর্নেল একট হাসলেন।…লেকভিউ রোডে আমাকে লক্ষ্য করে কে গুলি ছুঁড়েছিল সৌম্যবাবঃ আপনি, না সুভদ্র, না শ্যামলকান্তি!
শ্যামলদা। বিশ্বাস করা-না করা আপনার ইচ্ছে।
বিশ্বাস করতে আমি বাধ্য। শ্যামলকান্তি আমাকে একটা জলপ্রপাতের কাছে ধাক্কা মেরে খতম করতে চেয়েছিলেন।
সৌম্য আস্তে বললেন, শ্যামলদা বলেছিল। আপনি নাক গলানোতে আমরা ভয়। পেয়েছিলুম।
সুশোভনকে খুনের দৃশ্যের কত কপি প্রিন্ট করা হয়েছিল সৌম্যবাবু?