না। নাইট হল্ট করব। জিপ আনিনি। ট্রেনে এসেছি। শীতের রাতে ট্রেনজার্নি আমার বিশ্রী লাগে।
কোথায় থাকছেন?
আমার এক কলিগের কোয়ার্টারে। চতুর্বেদী সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, কিন্তু সেই মিনিস্টার ভদ্রলোককে খুঁজে বের করবেন কী ভাবে পুলিশের সাহায্য ছাড়া? বরং এক কাজ করা যায়। এখানে আই বি-র লোকেরা এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না, খোঁজ নিতে পারি।
কিন্তু–
চতুর্বেদী বাধা দিয়ে বললেন, ভাববেন না। ইনফর্মেশান ব্রাঞ্চের লোকেদের সঙ্গে সর্বত্র সাধারণ পুলিশের লোকেদের সম্পর্ক ভাল নয়। আদায় কঁচকলায় সম্পর্ক বলা চলে। সমস্যা হলো, আই বি জেনারেল পুলিশের লোকের সাহায্য ছাড়া আবার কোনো অ্যাকশান নিতে পারে না। তবে আমার ডিপার্টের সঙ্গে আই বি ডিপার্টের একটা বোঝাঁপড়া আছে।
এটা গোখরো সাপ নিয়ে খেলা, মিঃ চতুর্বেদী!
বুঝতে পারছি। খুব প্রভাবশালী লোক এবং—
কেরিয়ারিস্টরা যা হয়, তাই।
সুবিধাবাদী লোক বলুন!
ঠিক বলেছেন। কর্নেল আস্তে বললেন, লোকটি একসময় লেফটু এক্সট্রিমিস্ট দলে ছিল। দলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্ভবত দলকে খতম হওয়ার মুখে ফেলে দিয়ে বিপক্ষে ঢুকেছিল এবং পুরস্কার স্বরূপ মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। সুশোভন গোড়ার দিকেই সেটা টের পেয়ে দলকে জানিয়ে দিয়েছিল। পরিণামে পাল্টা সুশোভনকে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করে সে নিজের হাতে ওকে খুন করে। সে একজন খুনী চরিত্রের লোক। মিঃ চতুর্বেদী, লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে–অথচ তাকে দেখলে তা বোঝা যায় না। এই আমার ধারণা।
তেমন মন্ত্রী কেউ পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আপনি তো সহজেই জানতে পারতেন!
না মিঃ চতুর্বেদী।
জানাটা সহজ নয়। কেন? বয়স একটা ফ্যাক্টর। নিশ্চয় তিনি প্রবীণ নন। অতএব–চতুর্বেদী থামলেন।
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, একই বয়সের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড প্রত্যেকের মোটামুটি একই রকম। সবাই এঁরা বামপন্থী ছিলেন আগে। এঁদের মধ্যে মাত্র একজন কিছুকাল উগ্রবামপন্থী হয়েছিলেন। সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ প্রসঙ্গে খবরের কাগজে নিশ্চয় সে-সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত ছিল। তাই সেই খবর উধাও হয়ে গেছে সব কাগজের অফিসের ফাইল থেকে! পুলিশের ফাঁইল থেকেও।
হ্যাঁ–এও একটা পয়েন্ট। ওই যে বললেন, মাত্র কিছুকাল–ওটাই গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ বামপন্থী নেতা–হয়তো ওই পিরিয়ডে সে নেতাও ছিল না, বিশিষ্ট কর্মীই ছিল–কিছুকালের জন্য সুবিধাবাদের দরুন উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়ে আলাদা এবং উল্লেখযোগ্য কোনো খবর কাগজে নাও বেরুতে পারে।
ওই সুশোভনের মৃত্যুর খবরে ছাড়া তার নাম তত আলোচ্য ছিল না।
ঠিক। সুশোভনের মৃত্যুর খবরের মধ্যে একটু উল্লেখ থাকা সম্ভব।
কাজেই দেখুন, তাকে খুঁজে বের করা কঠিন।
হ্যাঁ, সমস্যাটা এবার স্পষ্ট হলো। চতুর্বেদী একটু চুপ করে থেকে বিরক্তভাবে ফের বললেন, কিন্তু কেয়াদেবী তো তাঁকে চেনেন। কেন আপনাকে বলেননি?
ভয়ে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
ভয়ে, নাকি অন্য কোন কারণে?
কর্নেল একটু ভেবে বললেন, ভয়ও একটা কারণ। তবে অন্য কারণও থাকতে পারে। যাই হোক, আপনি কালকের দিনটা থাকুন মিঃ চতুর্বেদী!
ঠিক আছে। বলে চতুর্বেদী আবার একটা সিগারেট ধরালেন।
মিঃ চতুর্বেদী!
চতুর্বেদী অন্যমনস্কভাবে বললেন, বলুন কর্নেল!
সেই মন্ত্রী এখন মোতিগঞ্জে এসেছেন।
চতুর্বেদী চমকে উঠে তাকালেন।
কর্নেল আস্তে বললেন, হ্যাঁ। তিনি এসেছেন। কারণ–
বলেই থেমে গেলেন। চতুর্বেদী তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কর্নেল আর সে কথায় গেলেন না। কারণটা ব্যাখ্যা করলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন। ঘরে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডাটা বেড়ে যাচ্ছে।…
১৯. জবানবন্দি
পার্কটার নাম স্টিফেনস পার্ক। ইংরেজ আমলেও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মোতিগঞ্জের রবরবা ছিল। ইংরেজদের কিছু কিছু কীর্তি এখনও টিকে আছে পার্ক, রাস্তাঘাট, ছিমছাম গড়নের গির্জা আর বাড়িতে। সেই বাড়িগুলোতে এখন সরকারি দফতর, স্কুলকলেজ। স্টিফেনস পার্কে এক কোণে ঘাসের ওপর বসে কর্নেল লক্ষ্য রেখেছিলেন। দশটা বেজে গেল। ভেবেছিলেন, সৌম্য ও কেয়া এখানে আসবে। এলো না। আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কর্নেল পার্ক থেকে বেরুলেন।
গঙ্গার ধারে সুন্দর পিচের রাস্তা, দুধারে গাছ কর্নেল হাঁটছিলেন। একটু চলার পর শহরে ঢোকার মুখে ডানদিকে ঘাট। প্রাচীন যুগের ঘাট। পাথরে বাঁধানো। এই শীতেও ঘাটে ভিড়। কাপড় কাঁচছে কেউ। কেউ জলে নেমে স্নান করছে। কিছু নৌকো ভেসে আছে ইতস্তত। সামনে গঙ্গার বিস্তার প্রায় দু কিলোমিটারের কম নয়। ডাইনে, বাঁয়ে চড়া উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু সামনাসামনি কোনো চড়া নেই। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে ওপারটা দেখতে থাকলেন। ঘন গাছপালার ভেতর একটা মন্দির চূড়া লেন্সে বড় হয়ে আটকে গেল। চূড়ায় ধ্বজা উড়ছে।
তারপর লেন্সে ভেসে উঠল একটা যাত্রীবাহী নৌকো। খোলা নৌকো। ভিড়ে ভর্তি।
এবং নৌকোয় সৌম্য, কেয়া!
ওপারে কোথায় যাচ্ছে ওরা? বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটা লোককে জিগ্যেস করলেন, উধার কৈ মন্দির হ্যাঁয়, ভাই?
জি বড়াসাব! লোকটি বিনীতভাবে বলল। নান্নিমাইজিকী আশ্রম ভি হ্যাঁয়! উও ওহি মন্দির।