চিনি। সবাই চেনে। কেয়া চোখে জল নিয়ে বলল। কার সাধ্য তাকে ছোঁয় এখন? পুলিশ–পুলিশেরও সে-হিম্মত আছে?
বুঝলুম। কিন্তু তোমার স্বামী রঞ্জন মিত্র তাকে ব্ল্যাকমেইল করত।
হ্যাঁ, করত।
যদি সত্যিই সে এখন এত শক্তিমান, কীভাবে রঞ্জন তাকে ব্ল্যাকমেইল করত? কেন সে রঞ্জনকে ধরিয়ে দিত না পুলিশের কাছে? কেন সে চুপচাপ টাকা গুনে দিত রঞ্জনকে?
কেয়া একটু চুপ করে থেকে চোখ মুছে আস্তে বলল, রঞ্জন একা তাকে ব্ল্যাকমেইল করত না। রঞ্জনের কাছে দাদার রক্তমাখা পোশাক ছিল শুধু। খুনের সময় যারা সেখানে ছিল, তারাও নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করত। কেউ সরকারি কন্ট্রাক্ট আদায় করত। কেউ বাসের পারমিট। কেউ শুধু বিদেশী মদ আদায় করেই খুশি থাকত।
কর্নেল ঝুঁকে গেলেন তার দিকে।…তুমি নিশ্চয় শ্যামল মজুমদার, সৌম্য চৌধুরী এবং বিমলবাবুর কথা বলছ?
কেয়া চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ওরা ব্ল্যাকমেইল করত নট ইন ক্যাশ, বাট ইন কাইন্ডস্।
আর সুভদ্র সিং?
বিশ্বাস করুন, তাকে আমি চিনি না।
কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে কিছুক্ষণ টানার পর ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে বললেন, কিন্তু তুমি তোমার দাদার খুনীকে তো চেনো। সম্ভবত তিনি এখন একজন মিনিস্টার। ইজ ইট?
কেয়া দু হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা করবেন। তার গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা কারুর নেই। যদি আমি নামটা বলি, আপনি পুলিশকে বলবেন এবং উল্টে পুলিশ আমাদের মা-মেয়েকে পথে বসিয়ে ছাড়বে। এমন কি, গুলি করে মেরে একটা কেস সাজাবে।
আমি কথা দিচ্ছি কেয়া, পুলিশকে বলব না। আমি শুধু জানতে চাই তিনি কে।
ক্ষমা করবেন। আপনারও সাধ্য নেই আমাকে বাঁচানোর। আমাকে কেউ মেরে ফেললেও ওই নাম বলব না। বলতে পারব না।
কর্নেল ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু শুধু রক্তমাখা পোশাক আর মুখের সাক্ষ্যের ভয় দেখিয়ে প্রভাবশালী একজন লোককে ব্ল্যাকমেইল করা যায় না। নিশ্চয় আরও কিছু নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ছিল। তুমি জানো, কী সেই প্রমাণ?
কেয়া আস্তে বলল, রঞ্জনের কাছে শুনেছি, একটা ফোটোগ্রাফ ছিল।
কিসের ফোটোগ্রাফ?
দাদাকে যখন খুন করছে, তখন ওদের কেউ একজন ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল। এর বেশি এক বর্ণও জানি না। আপনি বিশ্বাস করুন।
কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। সুশোভনকে খুন করা হবে, সেটা যেমন ঠিক করা ছিল, তেমনি কে খুন করবে তাও যেন ঠিক করা ছিল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, খুন করার সময় ছবি তুলে রাখার ব্যবস্থাও তৈরি ছিল। সমস্তটা যেন প্ল্যান করে সাজানো। তার মানে, (১) সুশোভনের খুনী কোনো বিত্তবান পরিবারের লোক এবং দলের নেতৃস্থানীয় ছিল। (২) সুশোভন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তারই বিরুদ্ধে। (৩) ফিল্মের নেগেটিভ থেকে কয়েকটা প্রিন্ট করা হয়েছিল। তা থেকে বিমলকুমারের মাথায় ওই বিমূর্ত ছবিটার আইডিয়া আসে। (৪) প্রেমিকার দাদা খুন হবে জানলে রঞ্জন আগেই সাবধান করে দিত। তার মানে, সে দৈবাৎ সেখানে উপস্থিত ছিল। (৫) খুনী টের পায়নি তার খুনের ছবি তোলা হচ্ছে। টের পাওয়ার কথাও নয়। হত্যার মুহূর্তে মানুষ অন্ধ হয়ে ওঠে। হিংসা তাকে অন্ধ করে। (৬) খুনী এখন দেশের নেতৃস্থানীয় এবং একজন মন্ত্রী। (৭) মোতিগঞ্জে তার ডেরা আছে একটা। গঙ্গার ধারে ওই ছোট্ট শহরটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। সেখানে বিত্তশালী এবং নেতা লোকেরা একটা বাড়ি করতেই পারে। (৮) রক্তাক্ত পোশাক হারিয়ে বিপন্ন বোধ করাই রঞ্জনের আত্মহত্যার কারণ। কর্নেল ধোঁয়ার রিঙের দিকে তাকালেন। ফিল্মের নেগেটিভটা ছোট্ট জিনিস। সেটা কোথায়, কার কাছে আছে? বোঝা যাচ্ছে, কেয়াকে এর বেশি মুখ খোলানো যাবে না। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে এবার। বললেন, ঠিক আছে আমি পুলিশকে অনুরোধ করব, যাতে তোমাদের হ্যাঁরাস না করা হয়।
কেয়া আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। হু, কেয়ার বাড়ি সার্চ করার উদ্দেশ্য সম্ভবত পুলিশের সাহায্যে ফিল্মের নেগেটিভটা উদ্ধার। রঞ্জনের প্রেমিকা এবং বউয়ের কাছে সেটা থাকার সম্ভাবনা ছিল। নিশ্চয় নেই। থাকলে কেয়া মনে জোর পেত। খবরের কাগজের দ্বারস্থ হত। ঢি ঢি পড়ে যেত চারদিকে। আজকাল বহু কাগজ ও ধরনের স্ক্যান্ডালের জন্য ছোঁক ছোঁক করে ঘুরছে।
কর্নেল চুরুট নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। জট অনেকটা ছাড়ল তাহলে।…
১৬. কেন, কেন এবং কেন?
বিকেলে রোদ্দুর আরও ফুটেছে। কিন্তু ছাদের প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে বেশিক্ষণ থাকা কঠিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কাছাকাছি উঁচু বাড়ি নেই বলে শীতের হাওয়ার দাপট বরাবরই এমন। তাতে আড়াইদিনের বৃষ্টি গেল। কর্নেল সেই মরু ক্যাকটাসগুলির ওপর থেকে পলিথিন শিট তুলে তাদের রোদ্দুর খেতে দিলেন। তারপর নেমে এলেন নিচের ড্রইংরুমে।
কেয়া চলে যাওয়ার পর থেকে এই কেসের ৮ দফা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বারবার মাথার ভেতর মাছির ঝাঁকের মতো ভনভন করছিল। টেবিলের সামনে বসে সেগুলি কাগজে লিখে ফেলে তাকিয়ে রইলেন। কিছু কি বাদ পড়ে গেছে?
হুঁ, সুশোভন রায়ের মৃত্যুসংক্রান্ত খবর সব কাগজের লাইব্রেরি থেকে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। পুলিশ দফতর থেকেও একটা ফাঁইলের তিনটে পাতা উধাও। এটা ৯ নম্বর সূত্র। সুশোভনের মৃত্যুর খবর এবং পুলিশ ফাঁইলের নথিতে সুশোভন সংক্রান্ত তথ্যে এমন কিছু ছিল, যা ওই প্রভাবশালী খুনী লোকটিকে জড়িত করে থাকবে। তাই এই সতর্কতা।