কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভেরিফাই করা একার ম্যাডাম।
বলত তো কোথায় চাকরি করে। কিন্তু বিশ্বাস হত না। ভদ্রমহিলা কড়া মেজাজে বললেন। মাঝে মাঝে দুমাস-তিনমাস বেপাত্তা। আবার হঠাৎ করে এসে গেল।
সনবাবু বললেন, সে ধরো–কোম্পানির কাজে বাইরে যেতেই হয়। ওটা কোনো ব্যাপার নয়। তবে প্রণব ওর সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি জানতে পারে। যদি ঘণ্টাখানেক ওয়েট করতে পারেন, এসে যাবে।
কর্নেল বললেন, তপেশবাবুর ঘরটা একটু দেখতে চাই।
সনবাবু স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা চাপা ও ষড়যন্ত্রসংকুল কণ্ঠস্বরে বললেন, ঘরে একটা ক্যাম্পখাট আর বিছানা ছাড়া কিছু নেই। একটা জলের কুঁজো পর্যন্ত না। কিছু না। এটাই কেমন যেন লাগত আমার।
ঘরটা দেখতে চাই। ফের কথাটা কর্নেল শক্ত গলায় বললেন।
সনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। …না, না। দেখাতে আপত্তি কী? আসুন, দেখাচ্ছি। কৈ গো, চাবিটা এনে দাও।
সনৎবাবুর স্ত্রীর কিন্তু খুব উৎসাহ লক্ষ্য করলেন কর্নেল। ঝটপট চাবি এনে দিলেন তিনি। দুপদাপ শব্দ করে পা ফেলে অনুসরণ করলেন। সনবাবু যখন তালা খুলছেন, ভদ্রমহিলা ফের চাপা স্বরে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, বরাবর আমার কেমন একটা খটকা ছিল তপেশের ওপর। কিন্তু প্রণবের বন্ধু। কিছু বললেই প্রণব মেজাজ দেখাত। একদিন দেখি–
সনবাবু ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলেছেন। কম পাওয়ারের আলো। কর্নেল তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। সনৎবাবুর স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি। উনি হঠাৎ থেমে গেলে বললেন, বলুন ম্যাডাম!
সনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, কী সব বলছ বুঝিনে! ছেড়ে দাও তো। পরের কথায় কাজ কী?
থামো! গৃহিণী প্রায় গর্জন করলেন। কর্নেলের দিকে ঘুরে তেমনি ষড়যন্ত্রসংকুল স্বরে বললেন, একদিন বিকেলে ছাদে ঘুরতে এসেছি এই দরজাটা খোলা। হঠাৎ দেখি, তপেশ বিছানায় বসে নোট গুনছে। এই এত্তো একশোটাকার নোট! সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল, ও লোক ভাল নয়।
সনৎবাবু খিক খিক করে হাসলেন। কী আশ্চর্য! টাকা গুনলে লোক ভাল হয় না! একেই বলে ফেমিনিন লজিক।
গৃহিণী চোখ কটমটিয়ে বললেন, অত্তো টাকা যার, সে এমনিভাবে থাকে। কোথায় পায় অত্তো টাকা? তোমায় বললুম তো উড়িয়ে দিলে!
সনৎবাবু বললেন, আহা! ওর কোম্পানির কালেকশানের টাকাও তো হতে পারে।
কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখছিলেন। দেয়ালে একটামাত্র ক্যালেন্ডার ঝুলছে। সেও গত বছরের ক্যালেন্ডার। ক্যাম্পখাটে শুধু একটা গুটোনো বিছানা। বিছানাটা খুলে বিছিয়ে দিলেন। পুলিশ সার্চ করে শুধু কেয়ার ছবি পেয়েছে। তবু তোশকটা টিপে টিপে কর্নেল তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করলেন। কর্তা-গিন্নি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল বালিশের ভেতরটাও খুঁজলেন। কিছু নেই। তারপর দেয়াল-ক্যালেন্ডারটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। দেখলেন কয়েকটা মাসের কিছু-কিছু তারিখের চারিদিকে গোল করে ডটপেনের বর্ডার। তারিখগুলি চিহ্নিত। ১৭ জুন, ২২ জুন, ৫ আগস্ট, ১২ অক্টোবর, ১৯ অক্টোবর, ১৫ ডিসেম্বর। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারাচিহ্ন। কর্নেল ভদ্রমহিলার দিকে ঘুরে বললেন, এই ক্যালেন্ডারটা পরীক্ষা করা দরকার। যদি অনুমতি দেন, নিয়ে যাব।
ভদ্রমহিলা উত্তেজিতভাবে বললেন, নিয়ে যান। পরীক্ষা করে দেখুন। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোক!
সনবাবু স্ত্রীর হাবভাব দেখে নীরস ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ–ও দিয়ে আর কী হবে? বিছানাটাও তো সরাতে হবে ঘর থেকে। নতুন ভাড়াটে আসবে সামনে মাসের পয়লা।
কর্নেল ক্যালেন্ডারটা খুলে জড়িয়ে হাতে নিলেন। বললেন, এনাফ! চলুন, নিচে যাই!
সিঁড়ির নিচে এক শক্তসমর্থ চেহারার যুবকের সঙ্গে দেখা হলো। ফিল্ম হিরোর আদলে পোশাক ও চুলের সাজ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে। সনবাবু একটু হেসে বললেন, প্রণব–আমার বড় ছেলে! পিন্টু, ইনি ইনসিওরেন্স থেকে তপেশের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করছেন। মোটা টাকার পলিসি আছে। নাকি।
পলিসির কথাটা একটু বাড়িয়ে বললেন সনত্বাবু। কর্নেল বুঝলেন, সনৎবাবু স্ত্রীকে যেমন, তেমনি ছেলেকেও সমঝে চলেন। হু, একটু দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ–অন্তত পারিবারিক ক্ষেত্রে। তবে এমন মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্টোটি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতি জাঁদরেল সম্রাটও ও সম্রাজ্ঞী বা পুত্রের কাছে কাবু থাকার কথা ইতিহাসে বিস্তর আছে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রণববাবু, আপনাকে আমার খুবই দরকার। কাল সকালে একবার সময় হবে কি? আমার কার্ড দেওয়া আছে আপনার বাবার কাছে।
সনৎবাবুর হাতেই ছিল কার্ডটা। প্রণবকে দিলেন। প্রণব দেখে নিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল। আস্তে বলল, আই সি! আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ?
তার বাবা-মা পরস্পর তাকালাকি করলেন। ইনভেস্টিগেটর কথাটায় যে আসলে ডিটেকটিভ বোঝায়, জীবনে এই প্রথম জানতে পারলেন যেন। দুটি মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ইয়ং ম্যান! শুনলুম, তপেশ আপনার বন্ধু ছিল। কাজেই আপনার সহযোগিতা আশা করি পাব।
প্রণব বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? তপেশ তো সুইসাইড করেছে। পুলিশই বলেছে।
হ্যাঁ, সুইসাইড। কর্নেল চুরুট বের করে লাইটার জ্বাললেন। ধোঁয়ার সঙ্গে বললেন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং কুয়্যার–কিছু গণ্ডগোল আছে। আপনি আপনার বন্ধুর জন্য আমাকে সাহায্য করুন।