কর্নেল বললেন, আমি ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
তিনি তো চলে গেছেন একটু আগে।
কর্নেল চেয়ারে বসে আস্তে বললেন, আমার কয়েকটা বিদেশী বইয়ের অর্ডার দেওয়া ছিল গত অক্টোবরে। একটু খোঁজ করবেন কি, প্লিজ?
রসিদ?
এই রে! রসিদটা তো হারিয়ে ফেলেছি। তবে আপনাদের অক্টোবরের অর্ডার ফাঁইলটা যদি দেখেন দয়া করে। আমার নাম কর্নেল এন সরকার। দুশো টাকা জমা দেওয়া আছে। ওয়েস্ট জার্মানির মেকার অ্যান্ড উইনবার্গার কোম্পানির প্রকাশিত বই।
মণিদা, দেখ তো! ইনি কী অর্ডার দিয়েছেন। ওয়েস্ট জার্মানি।
মিনিট কুড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না। কর্নেল উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, কী বিচ্ছিরি বৃষ্টি দেখুন তো!
নিচে শ্যামলকান্তি, সৌম্য ও সুভদ্র একটা কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ির কাছে যাচ্ছে। তারা গাড়িতে ঢুকল। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে কর্নেল সরে এলেন। বললেন, বরং কাল ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে এসে দেখা করব। উনি চেনেন আমাকে৷ সরি, আপনাদের কষ্ট দিলুম!
না, না। আপনি কাল আসুন সন্ধ্যা ছটার মধ্যে। ম্যানেজারবাবু বলতে পারবেন।…।
কর্নেল তিনতলার সেই ব্যালকনির কাছে গিয়ে দেখেন, পরিচারক ট্রেতে কফি নিয়ে বিরক্ত মুখে ফিরে আসছে। কর্নেলকে দেখে এবার হাসল।
ওদের নিশ্চয় কিছু বলার ছিল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলেন। বলার ছিল–অথচ এ মুহূর্তে তিনি শুনতে চান না ওদের কথা। বলার তাগিদ কতটা, সেটাই আঁচ করা দরকার আগে। তাগিদ বা গরজ যখন ওদের, তখন কোনোসময় যোগাযোগ করবেই।
বিল মিটিয়ে বখশিস দিয়ে নেমে এলেন নিচে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইচ্ছে হলো, মির্জাপুর স্ট্রিট হয়ে ঘুরে যাবেন। উইন্ডস্ক্রিন তুলে দিলেন। কলেজ স্কোয়ার চক্কর দিয়ে মোড়ে গতি একটু কমালেন।
রমাদের বাড়ির নিচে কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
কর্নেল চললেন বউবাজারের দিকে। ১৭/২ ফকিরচাঁদ লেনে তপেশ বসাক বা বাসুদেব রায় থাকত। পুলিশ তার ঘরে কেয়ার ছবি পেয়েছিল। প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে দশহাজার টাকার নোট ওই ঠিকানায় বুক পোস্টে মোতিগঞ্জ ডাকঘর থেকে পোস্ট করেছিল তপেশ ওরফে বাসুদেব।
বাড়িটা তিনতলা এবং তত বেশি পুরনো নয়। ছিমছাম, সুন্দর। নিচের তলায় একটা অফিস। দরজায় তালা। দোতলায় একটা ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল টিপলেন। একটু পরে এক ভদ্রলোক দরজার ফাঁক দিয়ে বললেন, কাকে চাই?
তপেশ বসাকের ফ্ল্যাটটা কোন তলায় বলতে পারেন?
দরজা খুলে গেল। কর্নেলকে দেখে নিলেন ভদ্রলোক–আপাদমস্তক। তারপর একটু হেসে বললেন, স্যার কি থানা থেকে আসছেন?
কর্নেল তার আইডেন্টিটি কার্ডটা এগিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কথাটা বোধ করি বুঝতে পারলেন না। বললেন, তপেশ আমারই ভাড়াটে ছিল। সে তো বিহারে কোথায় সুইসাইড করে মারা গেছে। সেদিন পুলিশ এসে ঘর সার্চ করে গেছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো স্যার?
আপনার নামটা জানতে পারি?
সনকুমার বোস। বিজনেস-টেস করি। নিচে অফিস–দেখেছেন বোধ করি।
তপেশবাবু সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই। নানা, আপনার বিব্রত হবার কারণ নেই। ওঁর একটা ইন্সিওরেন্সের ব্যাপারে ঝামেলা বেধেছে। তারই তদন্তে এসেছি।
একটু ইতস্তত করে সনৎবাবু বললেন, ভেতরে আসুন।
বসার ঘরটা ছিমছাম সাজানো। ভদ্রলোকের সৌন্দর্যবোধ আছে। সোফায়। বসে কর্নেল বললেন, তপেশবাবু কোন ফ্ল্যাটে থাকতেন?
তিনতলার সিঙ্গলরুম একটা মোটে ফ্ল্যাট। কর্পোরেশন তিনতলায় পার্মিশান দেয়নি। সনাবু কঁচুমাচু মুখে হাসলেন। যাই হোক, ম্যানেজ-ট্যানেজ করে ওই সিঙ্গলরুম ফ্ল্যাটটা টিকিয়ে রেখেছিলুম। বছর দুই আগে আমার বড় ছেলে প্রণব অনুরোধ করল, ওর এক কলেজ লাইফের বন্ধু ফ্ল্যাট খুঁজছে। তো প্রণবের কথায় তপেশকে দিলুম।
প্রণববাবু আছে কি?
বেরিয়েছে কোথায়।
কখন ফিরবেন?
বলা কঠিন। তবে রাত্তির নটার বেশি পর্যন্ত বাইরে থাকে না।
প্রণববাবু বলেছিলেন তপেশ তাঁর বন্ধু?
আজ্ঞে।
তপেশের ফ্ল্যাটে বাইরের লোকটোক আসত, জানেন?
সনৎবাবু একটু ভয় পেলেন যেন। গোঁফের একটা পাশ চুলকে বললেন, আমি তো বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। লক্ষ্য করিনি কিছু। ও তেমন আজেবাজে প্রকৃতির ছিল বলেও শুনিনি। তবে লোকের কথা বলছেন। সব মানুষেরই জানাশোনা লোক আছে। তারা যাতায়াত করতেই পারে। এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করি?
ধন্যবাদ। এইমাত্র কফিহাউসে কফি খেয়ে আসছি।
এক ভদ্রমহিলা পর্দা তুলে উঁকি দিচ্ছিলেন। সনাবু তাঁর উদ্দেশে বললেন, তপেশের ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে ইনি তদন্ত করতে এসেছেন। স্যার, প্রণবের মা।
কর্নেল তাকে নমস্কার করলে উনিও নমস্কার করে এ ঘরে এলেন। চেহারায় জাঁদরেল গিন্নির হাবভাব। সোফার একদিকে বসে বললেন, তপেশের কাছে। লোক-টোক তত আসত না। এমনিতে মেজাজ ভাল কিন্তু খুব রগচটা আর খামখেয়ালি ছিল। হাওর এক পিসতুতো না মাসতুতো বোন মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি।
রোগা ছিপছিপে চেহারা–ফর্সা রঙ?
হ্যাঁ। তবে আমার কিন্তু বিশ্বাস হত না, জানেন?
কর্নেল বুঝলেন, মেয়েদের চোখ। ঠিকই ধরেছিলেন। কেয়া আসত মাঝে মাঝে। বললেন, তপেশ কোথায় চাকরি করত জানেন?
বিচক্ষণ ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, সে তো আপনাদের রেকর্ডে লেখা থাকার কথা। ইনসিওরে কোম্পানি থেকে তদন্ত করতে এসেছেন বলছেন!