ষষ্ঠী ট্রেতে কেয়ার জন্য চা, কর্নেলের জন্য কফি এবং প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স রেখে গেল। কেয়া কর্নেলের কথায় অনিচ্ছার ভঙ্গিতে চায়ের কাপ তুলে নিল। একটু পরে কর্নেল বললেন, তুমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছ বলছিলে। সেটার দাম কত?
আড়াই লাখ প্রায়। এর মধ্যে বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইনসিওরেন্স, মায়ের গয়না বেচে এক লাখ দিয়েছি। বাকিটা দু কিস্তিতে দেবার কথা। নইলে ফ্ল্যাটের দখল পাব না। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি একেবারে। ট্রেডিং কনসার্নে টাইপিস্টের চাকরি করি।
কর্নেল ওর দিকে তাকালেন। গোপন কোরো না। তপেশ ওরফে বাসুদেব নিশ্চয় বাকি টাকা দেবে বলেছিল। না হলে ওই এক লাখ দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করতে না?
কেয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, হ্যাঁ। ও প্রতিশ্রুতি না দিলে রিস্ক নিতুম না। ওকে অবিশ্বাস করার কারণ তো ছিল না। তাছাড়া–
তাছাড়া?
কেয়া ধরা গলায় বলল, ও বলেছিল নতুন ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। আমার একটা বড় স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেল!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। ফ্ল্যাটের দখল না পেলে বেচবেই বা কেমন করে? ভুইফোড় সব হাউসিং কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তাদের জটিল ব্যবস্থা সরল লোকদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে।
কেয়া কেঁদে ফেলল। আমাকে আপনি বাঁচান, কর্নেল!
অধীর হয়ো না। দেখছি, কী করা যায়। কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। …, চা খেয়ে নাও। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। ভেবো না, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
কিছুক্ষণ পরে কেয়াকে লাল ল্যান্ডরোভারে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কর্নেল চললেন দক্ষিণে। মির্জাপুর স্ট্রিটে পৌঁছে তপেশ বসাকের বাড়ির দরগায় কড়া নাড়লেন। সেই বারো ঘর এক উঠোন। দরজা খুললেন এক অচেনা ভদ্রলোক। কর্নেল বললেন, মিসেস রমা বসাকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভদ্রলোক অবাক হয়েছিলেন। মুখে কেমন হাসি। বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো স্যার? তপেশ কে এমন কেউকেটা ছিল যে তার বউয়ের কাছে হর্দম গাড়ি চেপে সায়েবসুবো লোকেরা যাতায়াত করছেন?
হুঁ, রমার কাছে গাড়ি চেপে কেউ বা কারা যাতায়াত করেছে। কর্নেল বললেন, ইনসিওরেন্সের ব্যাপার। তদন্ত হচ্ছে। প্লিজ, রমা দেবীকে একটু খবর দিন।
একটু পরে রমা এসে কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সেদিন যে তার ঘরে গিয়েছিল, এরমা যেন সেরমা নয়। বিরক্ত এবং বিব্রত। বলল, বলুনকী বলবেন।
কর্নেলের গায়ে বর্ষাতি। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হাসলেন।… এখানে। দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। একটু সময় লাগবে।
রমা নির্লিপ্ত মুখে বলল, দেখেছেন তো মোটে একখানা ঘর। উনুন জ্বেলেছি। ধোঁয়ায় ভর্তি!
রমা, ব্যাংকের টাকা তুমি পাবে না–সে তো জানোই। তবু কেন অন্যের প্ররোচনায় বিপজ্জনক ফঁদে পা দিতে যাচ্ছ?
রমা শক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। ঝাঝালো স্বরে বলল, সে আমি দেখব। মামলা লড়ব।
তোমাকে কে এসে লোভ দেখিয়েছে, রমা?
রমার চোখ জ্বলে উঠল। বলল, আমি কি কচি মেয়ে? আমার স্বামীর নামে ডিপজিট–অন্য কেউ তার বউ সেজে দাবি করলেই হলো?
কর্নেল বুঝলেন, ওকে বোঝানো বৃথা। গাড়িওয়ালা কেউ এসে ওকে লোভ দেখিয়েছে।–নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, সাহসে বাঘিনী হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে না, তার স্বামীর মৃত্যুর পরও একাউন্টে ক্রমাগত টাকা পড়েছে এবং নমিনি কেয়া রায়-কাজেই তার দাবি টিকবে না। হুঁ, কারুর মৃত্যুর পর সেই লোকটির নামে কেউ টাকা জমা দিতেও পারে ধরা যাক, কোনো দেনাকারী দেনার টাকা তার পাওনাদারের মৃত্যুর পরও একাউন্টে জমা দিতে থাকে। এই ছুতো ধরেই রমার মুরুব্বি লড়বে হয়তো। এমন কী সেই মুরুব্বি কেয়ার বিয়ের কাগজটাও জাল বলে প্রমাণ করতে চাইবে। ঘুষ দেবে যথাস্থানে। আজকাল নয়কে ছয় করা কিছু কঠিন নয়। কিন্তু পরিণামে যদি মামলা জেতেও, টাকাটা রমা পাবে না, সেটা নিশ্চিত। তার মুরুব্বির হাতেই যাবে।
কর্নেল বললেন, যে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে, তার নাম কী রমা?
রমা বলল, অত কথার জবাব দেবার সময় নেই আমার। কোর্টে যা হবাস হবে।
সে চলে গেল। কর্নেল গাড়িতে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ মনে হলো, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের এক কাপ প্রখ্যাত কফি খেয়ে গেলে মন্দ হয় না।
সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল তিনমূর্তির সঙ্গে। শ্যামলকান্তি, সুভদ্র আর সৌম্য। দুপক্ষই থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর শ্যামলকান্তি সহাস্যে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেল!
কর্নেল বললেন, শীতের সন্ধ্যা এবং বৃষ্টি এক পেয়ালা কফি দাবি করে মিঃ মজুমদার।
আমাদের অবশ্য পুরনো অভ্যাস। ছাত্রজীবন থেকে এই কফিহাউসে আনাগোনা।
আমি কোনো প্রশ্ন করিনি, মিঃ মজুমদার।
শ্যামলকান্তি হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে নেমে গেলেন। সৌম্য ও সুভদ্রের মুখে নির্লিপ্ততা। কর্নেল উঠে গেলেন দোতলায়। উঁকি মেরে ভিড় দেখে তিনতলায় গেলেন। ডানদিকে ব্যালকনির মতো অংশে একটা টেবিল খালি দেখে বসলেন সেখানে। তিনতলায় ভিড়টা কম। এখানে কফির দাম বেশি। কফির অর্ডার দিয়ে ঝুঁকে দোতলার ভিড়টা দেখছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, দোতলার দরজা দিয়ে ফের শ্যামলকান্তি, সুভদ্র ও সৌম্য ঢুকছেন। তিনজনে মিলে কাকে খুঁজছেন যেন। কর্নেলকে? কর্নেল দ্রুত টেবিল থেকে উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে বেরিয়ে সামনে একটা বই কোম্পানির অফিস। দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দুজন কর্মচারী টেবিলে কাজ করছিলেন। একজন বললেন, নিচে স্যার, দোতলায় যান।