আসলে কোনো সময়ের ইতিহাস যিনি লেখেন, তারকাছে বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বগুলিই ধর্তব্য হয়ে ওঠে। আর ইতিহাস লেখা হয় ভাষায়। ভাষার নিজস্ব একটা রূপরীতি, কাঠামো এবং গতি আছে। নিজের অজান্তে ইতিহাস লেখক সেগুলির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাছাড়া তার উপাদান সংগৃহীত হয় খবরের কাগজ, সরকারি দলিল দস্তাবেজ কিংবা সুযোগ থাকলে গোপন পুলিশ রিপোর্ট থেকে। এখন কথা হলো, এগুলি কতখানি নির্ভরযোগ্য? সংবাদদাতারা রং চড়িয়েই লেখেন, যাতে লোকে উত্তেজিতভাবে গিলে খায়। এদিকে সংবাদপত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, স্বার্থ এসবও থাকে। বহু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বেরোয় না–স্থানাভাব এবং আরও নানা কারণে। আর সরকারি রিপোর্টও তাই। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুগত একটা যান্ত্রিক ও দায়সারা নীতি মাত্র। তদন্ত কমিশন বসে। তার মধ্যেও নানামুখী স্বার্থ কাজ করে। যারা কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেয়, নানা কারণে তা সত্যমিথ্যায় মেশা কথাবার্তা। পুলিশ রিপোর্ট তো আরও হাস্যকর। এই বইয়ে মুর্শিদাবাদের বিপ্লবী নেতা একরাম আলির কথা আছে। কর্নেলের মনে পড়ল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি গিয়েছিল সরেজমিন খবর আনতে। ফিরে এসে বলল, বোগাস। অজ গাঁয়ের এক নিরক্ষর খেতমজুর একরাম তার দাওয়ার ওপর দেয়ালে একটা লাল হরফে ছাপানো বিপ্লবীদের ইশতাহার সেঁটেছিল নেহাত দেয়ালের সৌন্দর্য আনতেই। দারোগাবাবু বিপ্লবীদের না পাকড়াও করতে পেরে রেগেমেগে ফিরে আসছিলেন। খোলামেলা ঘরের দেয়ালে ইশতাহার দেখামাত্র রোগাভোগা খেতমজুরটির বুকে নল ঠেকিয়ে রিভলবারের ট্রিগার টানেন। পরে তার প্রমোশনও হয়ে যায়। এই তো ব্যাপার।
না–পুলিশ রিপোর্ট মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। আসলে ইতিহাসকাররা দূরে বসে প্রতীয়মান বাস্তবকেই লক্ষ্য করেন। প্রকৃত বাস্তবকে জানতে হলে ঘটনার মধ্যে থাকতে হয়।
কিন্তু ঘটনার মধ্যে থাকারও একটা ব্যাপার আছে। বিপ্লবী নিজে যখন তার বিপ্লবকাজের বর্ণনা করেন, তখন তিনিও ভাষার নিজস্ব নিয়মের অধীন হয়ে পড়েন তো বটেই, উপরন্তু মানুষের সাধারণ স্বভাববশে তিনিও তাঁর কীর্তি ওপররঙ চড়ান।
একরাম আলির বুকে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঠেকিয়ে দারোগাবাবুর ট্রিগারে টান এবং একরাম আলির মৃত্যু–তথ্য হলো এইটুকুই। বাকিটা গণ্ডগুলে। এই বইটাতে, সুতরাং, কর্নেল শুধু তথ্য–নিছক তথ্য হাতড়াচ্ছিলেন দুদিন ধরে। ৫ তথ্য তার এই কেসে কাজে লাগবে, সেই তথ্য কোথায়?
বইটা মুড়ে চুরুট ধরালেন। হাতের কাছে কফির পেয়ালা। বিকেল চারটেতেই কলকাতা অন্ধকার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া বইছে তুখোড়। এইসময় কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠী এসে বলল, একজন মেয়েছেলে বাবামশাই! হাতে রাঙা ছাতি, কিন্তু যা বাতাস! ভিজে একশা।
কর্নেল আস্তে বললেন, আসতে বল্!
তপেশ বসাকের স্ত্রী হয়তো। কিছু কি ঘটেছে? সোজা হয়ে বসলেন। কিন্তু তাকে একটু চমকে দিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকল কেয়া রায়। চাঁদর ভিজে গেছে। খালি পা। জুতো ওয়েটিং রুমে খুলে এসেছে বোধ করি। মুখে প্রচণ্ড উদ্বেগ। নমস্কার করে বসে পড়ল। বলল, আমাকে চিনতে পারছেন!
হুঁ। তুমি কেয়া, প্রয়াত বাসুদেব রায়ের স্ত্রী।
কেয়া ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বলল, ওর নাম বাসুদেব ছিল কি না জানি না। আপনাকে সেদিন বলেছি, ওকে তপেশ বলে জানতাম। ওই নামেই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছিল।
কর্নেল একটু হাসলেন। অবশ্য ওর আসল নাম বাসুদেব রায় কি না তাও বলা কঠিন। হুঁ, বলো কী হয়েছে?
কেয়া একটু চুপ করে থাকার পর বলল, গতকাল শ্রীলক্ষ্মী ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বউবাজার ব্রাঞ্চ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি রেজেস্ট্রি ডাকে। লিখেছে, তপেশ বসাকের নামে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপজিট আছে এবং তার নমিনি করা আছে আমাকে আমার ঠিকানাও দেওয়া আছে।
স্ত্রী হিসেবে?
হ্যাঁ। কেয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। ব্যাংক লিখেছে, আরেক ভদ্রমহিলা তপেশ বসাকের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে টাকা ক্লেইম করেছেন। কিন্তু তপেশ বসাকের ডেথ সার্টিফিকেট দুবছর আগেকার। অথচ তারপরও গত আগস্ট পর্যন্ত তপেশ বসাক টাকা জমা দিয়ে গেছে নিয়মিত। কাজেই ব্যাংক তার ক্লেইম নাকচ করেছে। আমাকেই তারা টাকা দেবে।
ভেরি ইন্টারেস্টি! তারপর?
আমি হাথিয়াগড়ে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট আনব ঠিক করেছিলুম। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া টাকা তো ব্যাংক দেবে না। কিন্তু আজ সকালে এই বেনামী চিঠিটা লেটার বক্সে পেয়েছি। সাহস হচ্ছে না যেতে।
বলে কেয়া একটা ভাঁজ করা চিঠি দিল কর্নেলকে। কর্নেল চিঠিটা খুললেন। তাতে লেখা আছে :
তপেশ বসাকের টাকা তোমার প্রাপ্য নয়। তুমি ওর ব্যাংকের টাকা দাবি করলে মারা পড়বে। সাবধান।
কিন্তু হরফগুলো মুদ্রিত এবং নানা সাইজের হরফ। ছাপানো কাগজ থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা শব্দগুলি। কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ।
কেয়া বলল, আমি আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি, কর্নেল!
কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে না গিয়েও তুমি চিঠি লিখে এবং পুলিশের সাহায্যে ডেথ সার্টিফিকেটটা আনাতে পারো। বিয়ের রেজেস্ট্রি পেপার সাবমিট করতে পারো। কিন্তু–
কিন্তু বেনামী চিঠিতে আমাকে শাসানো হয়েছে।
হ্যাঁ। তুমি মেয়ে। মাথার ওপর কোনো পুরুষ গার্জেন নেই। ভাববার কথা।