সুভদ্রের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে বাসুদেব আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল। বাসুদেবের সঙ্গে ছিলেন মিঃ মজুমদার।
সুভদ্র শ্যামলকান্তির দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময়নাকি কর্নেল ভুল দেখলেন? আলো খুব আবছা। তাছাড়া সুভদ্র সিং-এর চোখদুটো সবসময় চিতা বাঘের মতো উজ্জ্বল।
শ্যামলকান্তি ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, সুভদ্র! হি ইজ ট্রাইং টু মিসলিড ইউ। ইউ নো, হায়াই আই ওয়েন্ট টু মিট ইউ।
সুভদ্র শ্বাস ছেড়ে মদে চুমুক দিল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বললেন সৌম্যবাবু!
সৌম্য চৌধুরী হিংস্র মুখে বললেন, ডোন্ট টক। আর একটা কথা বললে দাঁতের পাটি খুলে নেব।
কর্নেল হাসলেন। চেষ্টা করতে পারেন!
সৌম্য উঠে দাঁড়ালেন। শ্যামলকান্তি ও সুভদ্র তাকে ধরে বসিয়ে দিল। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন। সওয়া সাতটা বাজে। লেকভিউ রোড জনহীন। গাছের ঘনছায়া পড়েছে দুধারের ফুটপাতে। ট্যাক্সি চোখে পড়ছে না। ইনটুইশন! কেউ কি অনুসরণ করছে তাকে ছায়ার ভেতর? বাঁদিকের ফুটপাতে চলে গেলেন। সারবন্দি আধুনিক স্থাপত্য। বিত্তবানদের বাসভবন। একটা ব্লকের পর গলিরাস্তা। একটা প্রাইভেট কার চলে গেল। গাড়ির শব্দের ভেতর পিস্তল বা রিভলবারের শব্দ। ট্রেইন্ড কান কর্নেলের। দ্রুত গলিটায় ঢুকে পড়লেন। আবার একটা গুলির শব্দ, খুব কাছে। জনহীন গলিতে কয়েকটা মোটরগাড়ি পার্ক করা আছে। একটা গাড়ির আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসলেন। রিভলবার বের করলেন। কিন্তু লেকভিউ রোডের মোড়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। সম্ভবত আততায়ী ওপাশের ফুটপাতে গাঢ় ছায়ার ভেতর গাছের ছায়ার ভেতর গাছের আড়ালে আছে। গাড়ির পাশ দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললেন। সামনে একটা মাঝারি রাস্তার মোড়। উজ্জ্বল আলো। দোকানপাট আছে কিছু। একটা খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ইলিয়ট রোড। বখশিস মিলেগা। জলদি যানা পড়েগা!
শিখ ড্রাইভার হাসল।…আইয়ে। আইয়ে!
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ফোন করলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে। অরিজিৎ সাড়া দিয়ে বললেন, নো ফাদার ডেভলাপমেন্ট। সরি, কর্নেল!
অরিজিৎ, একটা প্রশ্ন।
বলুন।
বিমলবাবুর নামে কোনো রিভলবারের লাইসেন্স ছিল খোঁজ নিয়েছ?
অলরেডি। লাইসেন্স উইপন। দুবছর আগে লাইসেন্স যোগাড় করেছিলেন ভদ্রলোক।
একজন নিরীহ চিত্রশিল্পীর কেন রিভলভার দরকার হয়, অরিজিৎ? ভেবে দেখেছ কি?
সরি,, এই অ্যাঙ্গল্টা আমরা ভেবে দেখিনি।
উনি আক্রান্ত হবেন টের পেয়েছিলেন। কিন্তু মদই ওঁকে সে সুযোগ দিল।
ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট, কর্নেল! ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে।
ডার্লিং! আজ কিছুক্ষণ আগে আমিও আক্রান্ত হয়েছিলুম।
সর্বনাশ! কী ব্যাপার?
আততায়ী, দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
কোথায়, কোথায়?
উত্তেজিত হয়ো না। এমন বহুবার ঘটেছে আমার জীবনে।
আহা, জায়গাটা কোথায়?
লেকভিউ রোডে।
ওখানে কী করছিলেন?
গে ক্লাব থেকে ফিরছিলুম–পায়ে হেঁটে।
গে ক্লাবে কেন?
শ্যামলকান্তি মজুমদারের কাছে গিয়েছিলুম। তার কথা আশা করি ভুলে যাওনি। তার ব্যাকগ্রাউন্ড–
এক মিনিস্টারের আত্মীয়। ইলেকট্রনিক গুডসের ব্যবসা করেন।
পলিটিক্যাল ফাঁইল খুঁজতে বলেছিলুম, ডার্লিং!
কাজ চলছে। কিছু থাকলে আগামীকাল নাগাদ জানাতে পারব, আশা করি।
বিমলবাবুর কেসে কাউকে অ্যারেস্ট করার কথা কি ভাবছ তোমরা?
একটু পরে অরিজিৎ বললেন, চাপ আসছে। এটুকু বলতে পারি, খুব প্রভাবশালী মহলের চাপ। কেসটা নিয়ে প্রসিড করতে ভয় পাচ্ছেন অফিসাররা। আমি হেল্পলেস।
কর্নেল হাসলেন। তুমি একা লড়াই দিতে পারবে না, অরিজিৎ?
পারি–কিন্তু একা কতটুকু করা যাবে? অন্যান্য অফিসাররা সহযোগিতা না করলে কিছু করা কি সম্ভব? ভেবে দেখুন। যেমন ফাঁইল থেকে তিনটে পাতা উধাও হওয়ার ব্যাপারটা ধরুন। বড়জোর একটা গতানুগতিক ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত হবে। বাগচিবাবুর ট্রান্সফার হবে। আর কী হবে? প্রশাসনের অবস্থা তো জানেন।
ঠিক আছে। ছাড়ি ডার্লিং!
আমার মনে হয়—
বলো!
ছেড়ে দিন। খামোকা কে কখন কোত্থেকে গুলি করবে, আত্মরক্ষার সুযোগই পাবেন না।
ছিঃ অরিজিৎ! এ কী বলছ তুমি?
সরি, কর্নেল! বলতে বাধ্য হলুম। আমারও এ চাকরি করতে আর ইচ্ছে করছে না।
হুঁ, বুঝতে পারছি। কর্নেল শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, গুডনাইট! ছাড়ছি।
ফোনে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর ওপর যেমন, তেমনি অরিজিতের ওপরও অন্য আকারে হামলা ঘটেছে বোঝা গেল। প্রভাবশালী মহলের চাপ আসছে। তার মানে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এই কেসের সঙ্গে জড়িত। শ্যামলকান্তির আত্মীয় একজন মিনিস্টার। কে তিনি? কোন মিনিস্টার? গোড়া থেকেই অরিজিতও শুধু এক মিনিস্টার বলে আসছে। তিনি কে, তা বলছে না। নাকি অরিজিৎ-ও জানে না? শুধু তাকে বলা হয়েছে, শ্যামলবাবু একজন মিনিস্টারের আত্মীয়।
কর্নেল জ্বলন্ত চুরুট দাঁতে কামড়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন।…
১৩. বৃষ্টিসন্ধ্যার অভিযান
দুদিন ধরে আকাশ মেঘে ঢাকা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি ঝরছে থেমে-থেমে। ঠাণ্ডাটা। আচমকা প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কর্নেল দা পলিটিক্যাল টারময়েল ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিওরিং সিক্সটিজ-সেভেনটিজ বইটা খুঁটিয়ে পড়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। ইনডেক্সে বাসুদেব, সুশোভন কিংবা শ্যামলকান্তিদের উল্লেখ নেই। তবু একটা চেষ্টা, যদি দৈবাৎ কোনো সূত্র মেলে। মিলছে না।