তিনি যুবকটিকে অনুসরণ করছিলেন।
শহরের ভেতর তত বেশি ভিড় নেই। শীতের রাত্রি। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যুবকের রিকশা থামল একটি সুদৃশ্য হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম প্রিয়দর্শী। শহরের সবচেয়ে খরুচে হোটেল। সাহেবি কেতাদুরস্ত। যুবকটি বৃদ্ধকে লক্ষ্য করছিল না। তার মুখে এখন চাঞ্চল্য আর অন্যমনস্কতার সংমিশ্রণ। রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে সে দোতলায় সাত নম্বর সিঙ্গল বেডরুম বুক করল। বৃদ্ধ ঝুঁকে খাতায় লেখা তার নাম ঠিকানা দেখছিলেন। ম্যানেজার আঁকাবাঁকা ইংরেজি হরফে লিখেছেন : সুশোভন রায়। ঠিকানা : ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন, কলকাতা-৬। হাথিয়াগড় আসার উদ্দেশ্য : বিজনেস পারপাস। যুবকটিকে রুমে নিয়ে গেল একজন পরিচারক।
ম্যানেজার বললেন, বোলিয়ে সাব!
বৃদ্ধ বললেন, ফার্স্ট ফ্লোর নাম্বার এইট খালি হ্যাঁয়?
জি। লেকিন আঠ ডাবল বেড।
ঠিক হ্যাঁয়। আঠ। …
একটু পরে আট নম্বরে ঢুকে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করলেন! স্যুটকেসটিতে তালা আটা। কিটব্যাগ থেকে একটি মাস্টার কি বের করলেন, যার সাহায্যে সবরকমের সাধারণ তালা খেলা যায়। তালা খুললেন, কিন্তু স্যুটকেসটি খুলতে যেন একটু বিব্রত দেখাল তাঁকে। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন সেটির দিকে।
তারপর ওভারকোট খুলে রেখে দুপাশের চেনদুটো টেনে খুললেন। আবার একটু ইতস্তত করে ডালাটা একটু তুলে ধরলেন। ভেতরে কিছু ভঁজকরা পোশাক। ভাঁজকরা কিন্তু যেমন তেমন ভাবে জড়িয়ে রাখার মতো। আর সেই পোশাকগুলোও নোংরা, বেরঙা, ময়লার ছোপে ভরা। আলতো হাতে তুলে ভেতরটা দেখেই রেখে দিলেন। আর কিছুই নেই, শুধু জামাকাপড়!
এইসময় পাশের সাত নম্বর ঘরে চাপা কীসব শব্দ হলো। বৃদ্ধ দ্রুত, কিন্তু নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। করিডর জনশূন্য। এখন তার গলা থেকে ঝুলন্ত একটি বাইনোকুলার দেখা যাচ্ছিল। সাত নম্বরের দরজার কি-হোলে বাইনোকুলারের একটি আই রেখে এক চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করলেন ভেতরে কী ঘটছে।
দেখেই চমকে উঠলেন। টেবিলের উপর সেই স্যুটকেসটি খোলা। ভেতরে একগাদা পুরনো খবরের কাগজ দলাপাকানো এবং আরও কিছু ওইরকম কাগজ মেঝেয় ছড়ানো।
যুবকটি হিংস্র চোখে তাকিয়ে সেগুলো দেখছে।
তারপর সে বাকি কাগজগুলোও তুলে মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলল। এবার স্যুটকেসটা ফেলে দিয়ে লাথি মারল। তাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। সে চেয়ারের কাছে। দাঁড়িয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল। ক্রমশ তার চোখের হিংসার উজ্জ্বলতা ক্ষয়ে যেতে থাকল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ধপাস করে চোরে বসে পড়ল।
সেকেন্ড তিন-চার পরে সে জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পিস্তল। বের করল এবং অতিদ্রুত-এক মুহূর্তের মধ্যেই সে হাঁ করে পিস্তলের নল মুখে ঢুকিয়ে ট্রিগার টানল। চাপা-খুবই চাপা কটাস্ করে একটা শব্দ এবং সে সশব্দে চেয়ারসুদু উল্টে পড়ে গেল।
বৃদ্ধ হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথম ঘটনার চেয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘটে গেল।…
০২. জামায় রক্তের দাগ
কিছুক্ষণ পরে।
হোটেলের বাইরে পুলিশের দঙ্গল দেখে কিছু ভিড় জমেছে বটে, কিন্তু পাশেই বিস্তীর্ণ গঙ্গার জল ছুঁয়ে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। তাই ভিড় নিশ্চপ। হোটেলে কী ঘটেছে, জানার আগ্রহটাও মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছু লোক রাস্তার ধারে রবার পুড়িয়ে তাপ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। দুর্গন্ধ ছুটেছে। হোটেলে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না কনস্টেবলরা। একটা জিপ এবং অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাছে গেলেই লাঠি উঁচিয়ে গুতো মারতে আসছে পুলিশ। তবে দিনের বেলা হলে ভিড়টা প্রচণ্ডই হত।
দোতলার আটনম্বর ঘরে বসে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা, এস আই রাকেশ পাণ্ডে, ডিটেকটিভ দপ্তরের ইন্সপেক্টর সুরেশ চতুর্বেদী কথা বলছিলেন। সাত নম্বর সিঙ্গলবেড রুমে দুজন কনস্টেবল এবং একজন এস আই বডি পাহারা দিচ্ছেন। একজন ফোটোগ্রাফার এবং একজন ডাক্তারও আছেন সেখানে। ডাক্তারের নাম হরিনাথ মুখার্জি, বাঙালি। তিনপুরুষ বিহার মুল্লুকের এই হাথিয়াগড় শহরে বসবাস করেছেন।
ডাঃ মুখার্জি আট নম্বরে এসে ঢুকলেন। আস্তে বললেন, ইন্সট্যান্ট ডেথ। সুইসাইড।
মোহন শর্মা বললেন, সুইসাইড তো বটেই। পিস্তলটাও পড়ে আছে। মেঝেয়। বলে সেই বৃদ্ধের দিকে ঘুরলেন। একটু হেসে বললেন, গতবার দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে গিয়ে আপনার কথা উঠলো হঠাৎ। কে যেন বললেন, একটা প্রবাদ চালু হয়েছ ভারতব্যাপী, জানেন তো! হোয়্যার ইজ কর্নেল, এ ডেডবডি ইজ দেয়ার! কর্নেল যেখানে, মৃতদেহ সেখানে!
সুরেশ চতুর্বেদী হাসলেন। নিছক মৃতদেহ বললে ভুল হবে। হোয়্যার ইজ কর্নেল, দেয়ার ইজ এ মার্ডার। অবশ্য এক্ষেত্রে মার্ডারটা সুইসাইড! তাহলেও মার্ডার বলা চলে। কারণ আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক–স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন। মাথার টুপিটি টেবিলে। প্রশস্ত টাকে আলো টকটক করছে। সাদা দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানছিলেন অভ্যাসে–চোখ দুটি বন্ধ। মুখ তুলে এবার বললেন, আমার জীবনে এই এক অভিশাপ মিঃ চতুর্বেদী! কেন এমন হয়, এ রহস্যের অর্থ খুঁজে পাইনে। দিব্যি খুশমেজাজে বেড়াতে এলুম মোতিগঞ্জে। ওখানে গঙ্গার চরে পাখিটাখি দেখলুম। প্রজাপতি ধরার বিস্তর চেষ্টা করেও পারলুম না। দুপুরে ফিরে পোস্টাপিসে গেলুম একটা টেলিগ্রাম করতে। তারপর–