সুপ্রিয় বেয়ারাদের ধমক দিচ্ছিল। ফাঁইল দিয়ে তারা যেন নজর রাখে।
কফি খেয়ে কর্নেল বেরুলেন। আবার ভুল করছেন না তো? ওই তারিখের কাগজে কাটা জায়গাটায় সুশোভনের মৃত্যুসংবাদ ছিল, তার প্রমাণ কী? মৃত্যুসংবাদ যদি থাকেও, তাতে এমন কী তথ্য পাওয়ার আশা করেছেন?
স্টেটসম্যানে গিয়েও একই কাণ্ড। ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের কাগজে নিচের পাতায় তেমনি কাটা। এখানে কাটা অংশটা আরও বড়। তার মানে স্টেটসম্যান গুরুত্ব দিয়ে কোনো খবর ছেপেছিল–একটু বিস্তারিতভাবে।
একটা বেজে গেল কলকাতার সমস্ত বড় কাগজের অফিস ঘুরতে। সমস্ত কাগজে ১৯৭০ সালের ১৭ জুনের একটা জায়গা কেউ কেটে নিয়েছে। অতএব খবরটা বড় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু কী খবর? কেয়া বলেছে, তার দাদার বডি খুঁজে পাওয়া যায় ওই বছর জুন মাসে। ১৭ জুনের খবরটা যে সুশোভন সংক্রান্ত, তার ভিত্তি কী?
ফিয়ার্স লেনে এটা চীনা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে কর্নেল লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেলেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর চেম্বারের বাইরে বোর্ডে ইন চোখে পড়ল।
হাই ওল্ড ডাভ! অরিজিৎ হাসলেন। এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?
তুরুপের তাসের পাল্লায় পড়েছি ডার্লিং!
অরিজিৎ ঝুঁকে এলেন টেবিলের ওপর। আস্তে বললেন, কী ব্যাপার?
বলছি। ১৯৭০ সালের ১৭ই জুন সম্ভবত সুশোভন রায়-সংক্রান্ত একটা খবর সমস্ত কাগজের লাইব্রেরির ফাঁইলে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। তোমাদের রেকর্ডসে ওই তারিখে সুশোভন রায় সংক্রান্ত–
হাত তুলে ডি সি ডি ডি বললেন, বলেছি–খোঁজা হয়েছে। পাইনি।
১৯৭০ সালের ১৭ জুন নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে ওর বডি সনাক্ত করা হয়।
লেট আস ট্রাই এগেন। অরিজিৎ কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। একজন স্মার্ট চেহারার শাদা পোশাকের পুলিশ এসে সেলাম দিল। বললেন, এই স্লিপটা নিয়ে যাও। বাগচিবাবুকে দাও।
স্লিপে কিছু লিখে দিলেন। ফের বললেন, লাস্ট চান্স। দেখা যাক কী হয়।…
দীর্ঘ দশ মিনিট পরে নাদুস নুদুস চেহারার এক অফিসার হন্তদন্ত এলেন। সঙ্গে একজন বেয়ারা। তার হাতে এক গাদা ফাঁইল। অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। এগুলো থাক আমার কাছে।
অফিসার কর্নেলের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন। অরিজিৎ বললেন, ১৯৭০, ১৭ জুন এন আর এসে বডি-সুশোভন রায়? বলে ফাঁইল ওল্টাতে থাকলেন।
একটু পরে একখানে থেমে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, এ কী!
মিসিং?
তিনটে পাতা নেই! অরিজিতকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি তো হবেই। আগে ওই বাগচিবাবু–রেকর্ড কিপার, ওকে সাসপেন্ড করব। বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা!
কী ভেবেছে?
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।…ভুলে গিয়েছিলুম। কেয়া বা তার মা ফরেন্সিকে জামাপ্যাণ্ট সনাক্ত করতে গিয়েছিল কি?
অরিজিৎ আস্তে বললেন, দুজনেই গিয়েছিল। সনাক্ত করেছে। কর্নেল বেরিয়ে এলেন। ঠিক তুরুপের তাসের মতো কেউ বা কারা প্রতিটি দানের তাসগুলো জিতে নিচ্ছে। কে বা কারা তারা? একটা ব্যাপার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বা তারা প্রভাবশালী লোক।
লাল ল্যান্ডরোভারের গতি দক্ষিণে রেড রোড ধরে। চৌদ্দ নম্বর গোখেল পার্কের প্রিয়তমা নামে বাড়িটির লনে ঢুকে গাড়ি পার্ক করলেন কর্নেল।
দোতলার ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে কলিং বেল টিপলেন। ভেতর থেকে সাড়া এল, চলে এস শ্যামলদা। দরজা তোমার জন্য খুলে রেখেছি।
চিত্রকর বিমলকুমার তাহলে শ্যামলকান্তির জন্য অপেক্ষা করছেন।
কর্নেলকে দেখে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে! কে বলুন তো?
বিমলকুমারের হাতে মদের গেলাস। শিল্পী মানুষ। সারাক্ষণ কি মদ ছাড়া চলে না? কর্নেল বললেন, কাল রাত্রে আমি এসেছিলুম।
তাই বুঝি? আমার কিছু মনে থাকে না! বলুন, কী করতে পারি।
পোর্টেট আঁকানোর কথা বলেছিলুম।
মনে নেই। বসুন। এনি ড্রিংক?
ধন্যবাদ। কর্নেল ছবির গাদার পাশে সোফায় বসলেন!
বিমলকুমার ইজেলে ক্যানভাস এঁটে একটা ছবি আঁকছেন। গেলাসে চুমুক দিয়ে ওতে তুলির একটা পোঁচ টেনে পিছিয়ে এলেন। দেখার পর হাসি মুখে ঘুরে বললেন, আপনার পোট্রেট?
হ্যাঁ। আচ্ছা বিমলবাবু, কাল রাত্রে ওখানে যে ছবিটা দেখেছিলুম—
কোন ছবিটা বলুন তো?
অ্যাবস্ট্রাকটু পেন্টিং আমি বুঝি না। মনে হয়েছিল, যেন পিঠে ছুরি বেঁধা একটা মানুষ–সামনে ঝুঁকে পড়েছে।…
বিমলকুমার গেলাস ও তুলি রেখে এগিয়ে গেলেন বড় বড় ফ্রেমে আঁটা ক্যানভাসগুলির দিকে। দুমদাম এদিক-ওদিকে ফেলতে শুরু করলেন। পাগলের হাবভাব মুখে। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কোন শুয়োরের বাচ্চা ওটা চুরি করল? তাকে আমি মেরে ফেলব। একেবারে খতম করে দেব। তিন বছরের পরিশ্রম! ওঃ! আমার একটা মাস্টারপিস! প্যারি এক্সজিবিশনে পাঠানোর কথা ছিল।
ছবিগুলোতে লাথি মারতে থাকলেন বিমলকুমার। কর্নেল গিয়ে ধরলেন তাকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে বিমলবাবু!
শাট আপ! নো কথা! আমার মাস্টারপিস উধাও। দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন চিত্রকর। তারপর ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝেয়।
কর্নেল তাকে শান্ত করতে পারলেন না। তার কোনো প্রশ্নের জবাবও পেলেন না। বিমলকুমার পাগলের মতো লাথি মারতে থাকলেন মেঝেয় পড়ে থাকা ছবিগুলোতে। উন্মত্ত ভাঙচুর শুরু হলো।