কর্নেল ঠিকানাটা নোট বইয়ে টুকে নিয়ে উঠে পড়লেন। সত্যবাবু করিডোরে পৌঁছে ফের বললেন, খালি মনে হচ্ছে আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামটাও চেনা মনে হচ্ছে।
কর্নেল চুপচাপ এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে।.. মির্জাপুর স্ট্রিটের নতুন নাম সূর্য সেন স্ট্রিট। ৫৩/১ ই নম্বর বাড়িটা দোতলা এবং জরাজীর্ণ। অনেকগুলি পরিবারের বাসা। বারো ঘর এক উঠোন বলা চলে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে কর্নেলকে দেখে একটু ভড়কে
গেলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমি তপেশ বসাকের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে এসেছি।
আমি তপেশের বাবা। কিন্তু তপেশ তো—
জানি। উনি ১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
বৃদ্ধ আরও হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার স্যার? আমরা নিরীহ। সজ্জন লোক। প্রতিবেশীদের জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।
তপেশবাবুর স্ত্রী কোথায় আছেন? আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লেন কর্নেল।
বৃদ্ধ কঁপাকাঁপা গলায় বললেন, আমার কাছেই থাকে। আমার তো আর কেউ নেই। তপেশের ছেলে আছে বছর সাতেক বয়স। আর বউমা। ট্রান্সপোর্টে চাকরি করত তপেশ। সেখানে বউমা কাজ পেল না। অগত্যা–
বিধবা যুবতীদের দেখলে কর্নেল বিচলিত বোধ করেন। বৃদ্ধের পেছনে সে দাঁড়িয়ে ছিল। বৃদ্ধের কথা থামিয়ে সামনে এসে বলল, কী ব্যাপার?
আপনি কি তপেশবাবুর স্ত্রী?
হ্যাঁ। কিন্তু—
বলছি। তবে এভাবে তো কথা বলা যাবে না মা! একটু বসতে চাই।
আসুন।
নিচের তলায় একটা মাত্র ঘরে বাসা। বারান্দার কোনায় ছোট্ট কিচেন। চেয়ারে বসে কর্নেল নিজের কার্ডটি এগিয়ে দিলেন তপেশের বিধবা বউকে। কার্ডটি দেখে সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বৃদ্ধ খাটে বসেছেন। তার পা দুটো কাঁপছে। কর্নেল বললেন, তপেশবাবু পারিজাত ট্রান্সপোর্টে চাকরি করতেন। তাঁর একটা আইডেন্টিটি কার্ড ছিল। সেটা কি আছে?
বিধবা যুবতী আস্তে বলল, না। হারিয়ে গেছে।
হার্ট অ্যাটাক কোথায় হয়েছিল ওঁর?
এই ঘরেই। অফিস-যাবে বলে বেরুচ্ছে, হঠাৎ বুকে ব্যথা বলে খাটে গিয়ে বসল। তারপর–
হুঁ। ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আপনি নিশ্চয় চেনেন?
একটু ভেবে নিয়ে তপেশের বউ বলল, ও তেমন মিশুকে প্রকৃতির ছিল। বন্ধুবান্ধব বলতে শুধু বাসুদেব নামে একজন–ঠিকানা জানি না।
সে কি এ বাসায় আসত?
আসত মাঝেমাঝে। বাসুদেবকে আমি পছন্দ করতুম না।
চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
রোগা, শ্যামবর্ণ। চোখদুটো কেমন যেন। মেজাজও খিটখিটে।
আপনার স্বামীর হার্ট অ্যাটাকের সময় বাসুদেববাবু এসেছিলেন?
হ্যাঁ। সেই রিকশা ডেকে এন আর এস হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পেছনে আরেকটা রিকশায় আমি গেলাম। হাসপাতাল থেকে ওর অফিসে ফোন করা হয়েছিল।
মেডিকেল কলেজ হসপিট্যাল তো কাছেই ছিল। এন আর এসে কেন?
ওখানে বাসুদেবের চেনা ডাক্তার ছিল।
বাসুদেবের পুরো নাম মনে আছে?
তপেশের বউ একটু ভেবে বলল, বাসুদেব রায় বলে মনে পড়ছে। তবে কোথায় থাকত জানি না। কিন্তু এত দিন পরে কিসের এনকোয়ারি স্যার?
পরে যোগাযোগ করব। বলে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। শ্বশুর ও বউমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।…
কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার মোড়ে জ্যাম। আধঘণ্টা পরে জ্যাম ছাড়ল। কর্নেল বউবাজার ছাড়িয়ে ডাইনে ঘুরলেন। তারপর সেন্ট্রাল এভেনিউ ধরে এগিয়ে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন। সোজা তিন তলার লাইব্রেরি রুমে গিয়ে ঢুকলেন। লাইব্রেরিয়ান এখনও আসেননি। সহকারী সুপ্রিয় কর্নেলকে দেখে লাফিয়ে উঠল। হাই ওল্ড বস! জয়ন্ত আউট অফ স্টেশন বলে কি আমরাও তাই হয়ে গেছি? বসুন, আগে কফি আনাই ক্যান্টিন থেকে।
কর্নেল বললেন, ডার্লিং! কফি পরে। আগে আমি তোমাদের কাগজের পুরনো ফাঁইল দেখতে চাই।
আদেশ করুন।
১৯৭০ সালের জুন মাসের ফাঁইল।
সুপ্রিয় বিশাল লাইব্রেরির বইপত্তরের র্যাকের ভেতর অদৃশ্য হলো। একটু পরে বাঁধানো পুরনো দৈনিক সত্যসেবকের ফাঁইল এনে টেবিলে রাখল। তারপর ফোন তুলে ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিল।
কর্নেল জুন মাসের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। ১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় দৃষ্টি আটকে গেল। শেষ কলামে খানিকটা জায়গা কেটে নিয়েছে। বাকি ১৩ দিনের পাতাগুলো ওল্টালেন। সব ঠিক আছে। সুশোভন রায় সম্পর্কে জন মাসে কোনো খবর নেই।
সুপ্রিয় বলল, কী ব্যাপার?
১৭ জুনের কাগজে পাঁচের পাতায় এটা কাটা কেন সুপ্রিয়?
দেখামাত্র সুপ্রিয় জিভ কেটে কপাল চাপড়ে বলল, সর্বনাশ! কে কেটে নিয়ে গেল? কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে চাকরি যাবে! কী কাণ্ড দেখুন তো!
আমি আসার আগে কেউ পুরনো ফাঁইল দেখতে এসেছিল আজ?
সুপ্রিয়কে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল, আমি কঁটায় কাঁটায় দশটায় এসেছি। তবে লাইব্রেরি খোলে নটায়। বেয়ারাদের জিগ্যেস করি।
বেয়ারারা কেউ কিছু বলতে পারল না। সুপ্রিয় বলল, নিশ্চয় আজ এটা ঘটেনি। কেউ গতকাল কিংবা তার আগে এসেছিল ফাঁইল দেখতে। সেই কেটে নিয়ে গেছে। সমস্যা হলো, অসংখ্য লোক রিসার্চ পারপাসে ফাঁইল দেখতে আসেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেন অবশ্যি। কিন্তু ঠিক কবে কে এসে এ কম্মটি করেছে, সেটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল।
কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন।…চেপে যাও, সুপ্রিয়। কলকাতায় আরও কাগজ বেরোয়। অসুবিধে হবে না।