মাই গুডনেস!
তথাকথিত তপেশ–যে হাথিয়াগড়ে সুইসাইড করেছে, সে ছিল কেয়ার দাদা সুশোভনের বন্ধু। কেয়ার সঙ্গে তার গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল। সুতরাং কেয়া এখন বিধবা।
এরকম ট্রাজেডি সবসময় ঘটছে। যাই হোক, সকালে ওদের মা-মেয়েকে নিয়ে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে যাব। আর কিছু?
সুশোভন সম্পর্কে পুলিশ রেকর্ডে কী আছে, খুঁজে বের করা দরকার। কেয়া ও তার মায়ের কাছে সুশোভন খুন হওয়ার দিন তারিখ পেয়ে যাবে।
এনিথিং মোর।
আপাতত এই।…
কর্নেল ফোন রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ ফোন থেকে হাত তুললেন না। হুঁ—
আর একটা কী যেন বলার কথা ছিল, অন্যমনস্কতায় ভুলে গেছেন। জীবনে কখনও এমন বিষাদগ্রস্ত আর অন্যমনস্ক হননি কর্নেল। চিরকাল হাসিখুশি মানুষ। রসিকতায় ফেটে পড়েন একটুতেই। অথচ গভীর অপরাধবোধ তার বুকে চেপে বসেছে। কেন যে নাক গলাতে গেলেন তপেশের ব্যাপারে? দশ হাজার টাকার নোট কেউ বুকপোস্টে পাঠাচ্ছে, সে নিষিদ্ধ মাদকের চোরাকারবারি হবেই তার মানে কী? অথচ তার হাতের স্যুটকেসটি এবং টাকা পাঠানোর অদ্ভুত ব্যবস্থা তাঁকে গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছিল। বরং স্যুটকেসটি না বদলে তার সঙ্গে ভাব জমাতে পারতেন। সহজে ভাব জমানোর ক্ষমতা তো তার আছে। তা না করে তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিলেন
কিন্তু এখানেই আবার বড় খটকা। একটা খুনের প্রমাণ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সে এবং সেটা হাতছাড়া হওয়াই কি শুধু তার আত্মহত্যার কারণ?
তারপর শ্যামলকান্তি মজুমদারের প্রপাতের ধারে অতর্কিত ধাক্কা, বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত ছবিটা, এবং এ রাতে সার্কাস এভেনিউতে একটা জিপগাড়ির যেন তাড়া করে আসা…
এগুলো তাঁর নিজেরই দেখার ভুল কি না? দিনশেষের আবছা আলোয় পায়ের কাছে বাঁকা লতা থেকে শ্যামলকান্তি সাপ ভেবে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেও পারেন। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিমূর্ত ছবিটা…
নাঃ! চিন্তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিরক্ত কর্নেল ফোনের কাছ থেকে উঠে গেলেন। বুক কেসের সামনে একটু দাঁড়ালেন। কিছু বই পড়তে ইচ্ছে করছে না। বাতি নিভিয়ে বেড রুমে গিয়ে ঢুকলেন। শুয়ে পড়লেন।
সকালে অভ্যাসমতো ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে এলেন। কাগজ পড়তে পড়তে কফি খেলেন। কাগজে তপেশসংক্রান্ত কোনো খবর নেই। না থাকারই কথা। তবু যেন কিছু খবর আশা করেছিলেন। এও মনের ভুল। এই কেসটা তাকে ক্রমশ যেন বিমলকুমারের আঁকা বিমূর্ত চিত্রকলার জগতে টেনে নিয়ে চলেছে দুর্বোধ্য একটা পরিপ্রেক্ষিতে।
দশটায় বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি নিয়ে। ব্র্যাবোর্ন রোডে পারিজাত ট্রান্সপোর্টের হেড অফিস। দশতলা একটা বাড়ির পাঁচতলায় অফিসটা। কার্ড পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ডাক এল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পরিতোষ ব্যানার্জির চেম্বার থেকে। পরিতোষবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রাশভারি চেহারা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। নাদুসনুদুস গড়ন। অনবরত পান খাবার অভ্যাস। কর্নেলকে বসিয়ে করজোড়ে বললেন, বলুন স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য।
তপেশ বসাক—
পরিতোষবাবু নড়ে বসলেন।…ও হ্যাঁ। কাল আমি ছিলুম না। এইমাত্র এসে। শুনলুম, পুলিশ এসে তপেশের খোঁজখবর করেছে। ওর আইডেন্টিটি কার্ডে নাকি অন্য লোকের ছবি আছে। আমি তো স্যার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি নে। এবার আপনি এসেছেন–প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা আছে আপনার কার্ডে।
কী ব্যাপার বলুন তো? কিসের ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে তপেশের নামে? সে তো খুব ভাল লোক ছিল। অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী।
ছিল–মানে এখন নেই উনি?
পরিতোষবাবু বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তলায় টিনের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে মুখ থেকে পানের গুঁড়ো ফেলে বললেন, তপেশ বছর পাঁচেক আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। কোম্পানি ওর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেনি।
তখন তার বয়স কত ছিল?
তা পঁচিশ-পঁচিশ হবে।
ওঁর কোনো ছবি আছে আপনাদের অফিসে?
পরিতোষবাবু হাসলেন।..ছবি রাখার প্রশ্ন ওঠে না। সে নিতান্ত রিপ্রেজেনটেটিভ ছিল। বাইরে টাকাপয়সা আদায়ে যেত। তাছাড়া আমাদের হাউস জার্নালও
বেরোয় না যে কর্মচারীদের ছবি খুঁজে পাবেন।
ওঁর বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয় পাওয়া যাবে অফিস রেকর্ডে!
যাবে। তবে কালই পুলিশ নিয়ে গেছে হয়তো–এক মিনিট। ভেরিফাই করে নিই।
পরিতোষবাবু বেলের সুইচ টিপে একজন বেয়ারাকে ডেকে বললেন, সত্যবাবুকো বোলাও। একটু পরে স্মার্ট এবং প্যান্ট শার্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে একটু হেসে বললেন, এঁকে কোথায় দেখেছি যেন?
পরিতোষবাবু বললেন, সত্য! উনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তপেশ সম্পর্কে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছেন। কাল পুলিশও এসেছিল বললে!
সত্যবাবু এসে বললেন, তপেশকে নিয়ে এত দিন পরে কিসের তদন্ত? সে তো হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে নাইনটিন সেভেনটি সিক্সের ফোর্থ জুলাই।
কর্নেল বললেন, ওঁর বাড়ির ঠিকানাটা দরকার।
দিচ্ছি। একটু বসুন।
সত্যবাবু উঠে গেলে পরিতোষবাবু বললেন, তপেশের কোনো ইনসিওরেন্স পলিসি নিয়ে ঝামেলা বেধেছে কি স্যার?
কর্নেল মাথাটা একটু দোলালেন। হ্যাঁ বা না দুই-ই বোঝায় এতে।
সত্যবাবু ফিরে এলেন একটা পুরনো ডাইরি নিয়ে। বললেন, ভাগ্যিস ডাইরিগুলো ফেলে দিইনি। এই যে! লিখে নিন স্যার। ৫৩/১ ই মির্জাপুর স্ট্রিট। অবশ্যি যদুর মনে পড়ছে, ওটা ওদের ভাড়ার বাড়ি ছিল। ওর আত্মীয়স্বজনের খবর জানি না। কলকাতায় যা বাসার প্রব্লেম, ওঁরা ওই বাড়িতে থাকতেও পারেন।