কর্নেলের দৃষ্টি ছবিগুলোর দিকে। একটা ছবি দেখে চমকে উঠলেন। ছবিটা প্রকাণ্ড ক্যানভাসে আঁকা এবং তেলরঙা। বিমূর্ত আকার। কিন্তু একজন মানুষই বটে। একটু লক্ষ্য করার পর শিউরে উঠলেন। পিঠের ওপর ওটা কি ছোরার বাঁট? হুঁ–বিমূর্ত আকৃতির মানুষটি ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। পুতুলের মতো দুটো প্রকাণ্ড চোখের আদল–তাতে বিস্ময়ের ঝলক রঙের তীব্রতায় ছড়িয়ে পড়েছে।
বিমলকুমার অনর্গল অসম্বদ্ধ কথা বলছেন। কর্নেল ছবিটা সম্পর্কে প্রশ্ন . করতে যাচ্ছেন, কলিং বেল বাজল। অমনি বিমলকুমার মদের গেলাসটা সোফার তলায় রেখে ঠোঁটে আঙুল লম্বালম্বি তুলে কর্নেলকে আগের মতো বললেন,– শ্-শ্! তারপর গিয়ে দরজা খুললেন।
তার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন শ্যামলকান্তি মজুমদার আর সুভদ্র সিং!
ঢুকেই দুজনে কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর শ্যামলকান্তি সহাস্যে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো কর্নেল!
কর্নেল কিছু বলার আগে বিমলকুমার জড়ানো গলায় বললেন, কর্নেল! ওরে বাবা! মিলিটারির লোক আমার ঘরে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! কেন বাবা? এখানে আবার মিলিটারি কেন?
শ্যামলকান্তি তাকে ধমক দিলেন, শাট আপ! উনি কে জানিস ব্যাটা?
তারপর জানালার পাশে টেবিলে সারবন্দি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ঠেলে সেখানে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলেন। সুভদ্র একটু ইতস্তত করে সোফায় বসল। বিমলকুমার দাঁড়িয়ে আছে। রাগী দৃষ্টি শ্যামলকান্তির দিকে বললেন, কটায় আসার কথা ছিল তোর? রাস্কেল!
শ্যামলকান্তি জিভ কেটে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ছিঃ বিমল! কী হচ্ছে? উনি কে–
উনি আমার দাদা! সান্তা ক্লজদা! বিমলকুমার সোফার তলা থেকে সেই গেলাসটা বের করে চুমুক দিলেন। তারপর ফের বললেন, তাদের জন্য কষ্ট করে খাঁটি ভোদকা সংগ্রহ করলুম। আর তোরা আসতে আসতে রাত পুইয়ে দিলি! তবে হ্যাঁ–আমি এককথার লোক। ছিপি খুলিনি। এটা কী খাচ্ছি। বল্ তো? মহুয়া! ঘাটশিলা থেকে পাঁচ বোতল এনে রেখেছি। আমি বাবা রুশপন্থী নই। ভোদকাতে নেই। আমি বরাবর লিন পিয়াওপন্থী। তোরা তো জানিস–
সুভদ্র রেগে গেল…বিমল! ইউ আর ড্রাংক! ডোন্ট টক।
বিমলকুমার হাসতে হাসতে পাশের ঘরে ঢুকলেন পর্দা তুলে। শ্যামলকান্তিকে এবার গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন, কর্নেল সায়েবকে এখানে দেখে একটু অবাক হয়েছি!
কর্নেল বললেন, গে ক্লাবে আপনার খোঁজে গিয়েছিলুম। শুনলুম, আপনি এখানে আছেন।
আমার খোঁজে কেন জানতে পারি?
কিছু প্রশ্ন ছিল।
বেশ তো! বলুন।
কর্নেল লক্ষ্য করলেন শ্যামলকান্তির চেহারার সেই আমায়িকতা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। আর সুভদ্রেরও চেহারায় অনুরূপ একটা বৈপরীত্য ফুটে উঠছে। হিংস্র ও খাঁচায় ভরা চিতাবাঘের চাঞ্চল্য যেমন। সে কর্নেলের বাঁদিকে এক মিটার দূরে বসে আছে। কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চুরুট বের করলেন। আগেরটা অ্যাসট্রেতে দুমড়ে নিভিয়ে গুঁজে দিলেন। পকেটে হাত ঢোকানোর সময় তার চোখ দুজনকে লক্ষ্য করছিল। ওরা পরস্পর তাকিয়ে যেন কিছু বলল। নাকি দৃষ্টির ভুল কর্নেলের?
চুরুট জ্বেলে বললেন, শ্যামলবাবু! আপনি কি সুশোভন রায় নামে কাউকে চেনেন–আই মিন, চিনতেন?
হু ইজ হি?
বিডন স্ট্রিট এলাকায় গোবিন্দ নস্কর লেনে থাকত।
শ্যামলকান্তি মাথা দুলিয়ে বললেন, না। ও নামে কাউকে চিনতুম না বা এখনও চিনি না।
কেয়া রায়কে?
শ্যামলকান্তি হেসে উঠলেন। অ্যাবসার্ড প্রশ্ন! আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন আমি জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি ভুল রাস্তায় হাঁটছেন। আপনার বয়সই এজন্য দায়ী, কর্নেল! আপনার মধ্যে সেনিলিটি এসে গেছে। সর্বত্র দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় না। তাছাড়া–
বিমলকুমার বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে। হাতে ভোদকার সাদা বোতল, বগলে একটা জলের বোতল এবং অন্য হাতে কয়েকটা গ্লাস। নিচু টেবিলে রেখে বললেন, আয় শ্যামলদা! সান্তা ক্লজদার স্বাস্থ্যপান করা যাক।
শ্যামলকান্তি জের টেনে বললেন, তাছাড়া রিয়েলিটিও দ্রুত বদলাচ্ছে। আপনার বোধবুদ্ধি–প্লিজ এক্সকিউজ মি ফর দা কমেন্ট আপনার বোধবুদ্ধি আটকে আছে পুরনো রিয়েলিটিজে। রিয়েলিটি বদলাচ্ছে বলেই সিচুয়েশন বদলাচ্ছে। দশ বছর আগে যা সত্য ছিল, এখন তা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে।
বিমলকুমার খাপ্পা হয়ে বললেন, কী সারগর্ভ তত্ত্ব আওড়াচ্ছিস শ্যামলদা? শ্-শ্-শ্! আয়, ছিপি খুলে খা। হ্যাঁ–সান্তা ক্লজদা, আপনি কি যেন আঁকার বলছিলেন?
কর্নেল বললেন, পোট্রেট।
বিমল! হি ইজ আ ডিটেকটিভ! শ্যামলকান্তি এগিয়ে এলেন।
বিমলকুমার ভুরু কুঁচকে বললেন, ডিটেকটিভ! সে তো বইয়ে থাকে, বাবা! বইয়ের পাতা থেকে পোকা বেরুতে দেখেছি। কিন্তু ডিটেকটিভ—ইমপসিব্ল!
শ্যামলকান্তি মুখোমুখি সোফায় বসে বোতলটির ছিপি খুললেন। একটা গ্লাসে খানিকটা ঢেলে কর্নেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন, থ্যাংকস!
শ্যামলকান্তি গেলাসটাতে জল মিশিয়ে সুভদ্রকে দিলেন। আর একটা গেলাসে ঢেলে নিয়ে জলের বোতল থেকে জল মেশালেন। সুভদ্রের গেলাসে নিজের গেলাস ঠেকিয়ে বললেন, চিয়ার্স!
এইসময় পাশের ঘরে ফোন বাজল। বিমলকুমার টলতে টলতে ফোন ধরতে ঘরে ঢুকলেন। শ্যামলকান্তি ভোদকায় চুমুক দিয়ে বললেন, বাপ! ডেঞ্জারাস জিনিস! গলায় ড্যাগার ঢুকে গেল যেন।