বিশাল টেন্টের গড়ন ক্লাবঘরের ভেতর ভিড়, চাপা কোলাহল, টেবিল ঘিরে। স্ত্রী-পুরুষের আঁক। হাতে-হাতে রঙিন পানীয় ভরা গেলাস। নানাবয়সী। স্ত্রীলোকগুলিকে রঙকরা প্রতিমা দেখাচ্ছিল। ইতস্তত কিছু সায়েব-মেমসায়েব চোখে পড়ল। সম্ভবত এ শহরে তারা নবাগত এবং এখনও এটাই রেওয়া
যে ইউরোপীয়রা এলেই ঝাঁকে ঝাকে বন্ধু ও খিদমতগার জুটে যায়। কর্নেল শ্যামলকান্তিকে খুঁজছিলেন। ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি। কলোনিয়াল হ্যাংওভার একেই বলে। এইসব ইউরোপীয় হয়তো স্বদেশে নিতান্ত সাধারণ জন, কিন্তু এদেশে তারা ভি আই পি!
বাইরে বাগানে মৃদু আলোয় ইতস্তত রঙিন ছাতার তলাতেও ঝক ঝক মানুষ। সবাই নিশ্চয় মেম্বার নন। অতিথি-অভ্যাগতের সংখ্যাই বেশি। নিজেদের হাই সোসাইটিকালচার দেখাতে মেম্বাররা ডেকে এনেছেন। এটাই নিয়ম। নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য অন্যকে না দেখালে জীবন ও রোজগার নিরর্থক ঠেকে।
কিন্তু কোথায় শ্যামলকান্তি? তন্নতন্ন খুঁজে তার পাত্তা পেলেন না কর্নেল। তাকে কেউ লক্ষ্য করছিল না। করার কথাও নয়। অগত্যা একজন পরিচারককে জিজ্ঞেস করলেন শ্যামলকান্তির কথা। সে কর্নেলকে দেখেই সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকেছিল। তাগড়াই, স্মার্ট, এই দাড়িওয়ালা ও টুপিপরা বৃদ্ধের চেহারায় ইউরোপীয় আদল এবং ভঙ্গি আছে। সে বলল, মজুমদারসাব সামকো আয়া। লেকিন থাড়াসা বাদ চলা গেয়া স্যার! ঠারিয়ে, হাম পুছকে আতা!
একটু পরে সে কাউন্টারের দিক থেকে ফিরে এসে বলল, মজুমদারসাব, বালকে গেয়া, কৈ মেরে লিয়ে আয়ে নে উনিকো বোল দেনা চৌদ্দ নাম্বার গাখেল পার্কমে মুখুর্জি সাবকা কোঠি চলা যাইয়ে।
চোদ্দ নম্বর গোখেল পার্ক। মুখার্জিসায়েব। নিশ্চয় গে ক্লাবের মেম্বার। পরিচারিকাটির বলার ভঙ্গি দেখে সেটা বোঝা গেছে। রাস্তাটা এখান থেকে তত দূরে নয়। পৌঁছুতে মিনিট পাঁচেক লাগল। বাড়িটা নতুন। গেটে দারোয়ান আছে। ভেতরে লন, বাগিচা ও গাড়ি পার্ক করার জায়গা আছে। গেটের পাশে লেখা আছে প্রিয়তমা। নামটা সুন্দর। কিন্তু চারতলা ছিমছাম আধুনিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি বাড়িটা একজনের নয় বলে মনে হলো কর্নেলের। অনেকগুলি ফ্যাট আছে।
ভেতরে গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে গেলেন কর্নেল। এক ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন, মিঃ মুখার্জি।
ভদ্রমহিলা নিঃশব্দে পাশের দেয়ালে লেটারবক্সের দিকে আঙুল তুলে কর্নেলকে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলেন। মনে হলো, মুখার্জি ভদ্রলোককে তিনি পছন্দ করেন না যেন। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির সব আগন্তুক সম্পর্কে ওঁর ভুরুকোঁচকানো প্রশ্ন আছে। কর্নেল সিদ্ধান্ত করলেন, মুখার্জি এ বাড়িতে সম্ভবত অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এবং প্রচুর অবাঞ্ছিত লোকজন তার কাছে আসেন!
লেটার বক্সে বিচিত্র ও ছন্দোবদ্ধ রেখায় লেখা আছে : বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনতলা, ৪। তলায় একটা খুদে রঙিন ছবি। মুখের ছবি বলে মনে হয়। বিমূর্ত। ভদ্রলোক কি চিত্রকর?
চিত্রকর। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। বেঁটে, রোগাটে গড়ন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মাথায় এলোমেলো একরাশ চুল। গোঁফ-দাড়ি আছে। পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে। একটা দিশি চিত্রিত কথার মতো চাঁদর গায়ে কোনোমতে জড়ানো। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন! কী সেবা করতে পারি।
কর্নেল বললেন, আপনি পেইন্টার?
চিত্রকর।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, চিত্রকর। তো শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে এক ভদ্রলোক–
ও একটা হারামজাদা! বিমলবাবু কুদ্ধস্বরে বললেন! কথা দিয়ে কথা রাখে না। ওকে বিশ্বাস করবেন না।
কর্নেল বুঝলেন, শ্যামলকান্তি এখানে নেই। বললেন, আমি নিজের একটা পোট্রেট আঁকাতে চাই। তো শ্যামলবাবু–
ঠোঁটে আঙুল লম্বালম্বি রেখে বিমলবাবু বললেন, শ্-শ্-শ্! ও একটা শুওরের বাচ্চা।
আপনি কি ভেতরে যেতে দেবেন না আমাকে?
বিমলবাবু হাসলেন। ওরে বাবা! আপনি খদ্দের, মা লক্ষ্মী। আসুন আসন। তবে শ্যামলের কথা নয়। ও এক বিপজ্জনক প্রাণী।
ঘরটি বড়ো। স্টুডিও। এখানে-ওখানে ডাই করা ক্যানভাস–ফ্রেমে বাঁধানো। দেয়াল, মেঝে সবখানে শুধু ছবি। অসংখ্য ছবি। বিমূর্ত। একপাশে সোফাসেট। সেখানেও ছবির গাদা। বিমলবাবু ছবি সরিয়ে বললেন, বসুন। তারপর কথা হচ্ছে।
হুঁ, বিমলকুমার নেশাগ্রস্ত। এককোণে উঁচু টুলের ওপর মদের গেলাস। গিয়ে এক চুমুক টেনে কর্নেলের দিকে ঘুরে হঠাৎ খি খি করে হাসলেন।…আপনি আমার বাপের বয়সী। কিছু মনে করবেন না মশাই! ওই যে কিসব বলে লোকে-সামাজিক নীতিবোধ, মূল্যবোধ-টোধ–ওসব আমার সয় না। ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি-স্বাধীন হয়ে জন্মায়। কিন্তু স্বাধীন হয়ে বাঁচতে বা মরতে পারে না। তাকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে এবং মরতে দেওয়া উচিত নয় কি?
অবশ্যই। বলে কর্নেল টুপি খুলে ফেললেন। চুরুট ধরালেন। অ্যাশট্রে আছে নিচু টেবিলটাতে।
বিমলকুমার খুশি হয়ে আরেক চুমুক গিলে কাছে এলেন।… আপনাকে দাদা বলি বরং!
বলুন না!
বিমলকুমার পাশে বসে পড়লেন।…দাদা, আপনার চেহারা ক্রিসমাসের সান্তা ক্লজের মতো। শুধু একটাই গণ্ডগোলসান্তা ক্লজের টাক নেই। আপনার আছে। সো হোয়াট? টাক নেই তো নেই। যাদের টাক নেই, তারা কি কষ্টে আছে? আমারও টাক নেই। আমি কি কষ্টে আছি? কক্ষনো না। আ হ্যাঁপি লাইফ!