তাই বুঝি?
হ্যাঁ তবে বড় বুদ্ধিমান ছেলে। খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। অথচ কবে সেই দু বছরের বাচ্চা যখন, তখন মায়ের কোলে চেপে এসেছিল।
কর্নেলের কান ছিল শংকরের কথায়, কিন্তু দৃষ্টি ছিল সামনে ফুলবাগিচার দিকে। হঠাৎ তিনি এক ধাক্কায় শংকরকে চেয়ার থেকে ফেলে দিলেন এবং নিজেও শুয়ে পড়লেন। পরক্ষণে প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল গুলি ছোঁড়ার। ঘরের দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবির কাচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল। বারুদের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে চৌকিদার চিৎকার করে উঠল—ডাকাত পড়েছে! ডাকাত পড়েছে!
এক লাফে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং জানালার পাশে নিজেকে আড়াল করে টর্চ জ্বাললেন। তার অন্য হাতে গুলিভরা রিভলভার দেখা গেল।
কিন্তু তখনই ফের স্তব্ধতা ঘনিয়ে এসেছে। ফুলবাগিচার ওদিকে কেউ নেই। চৌকিদার বোধ করি চেঁচিয়ে ওঠার পরই আতঙ্কে চুপ করে গেছে।
শংকর মেঝে থেকে উঠে বললেন—আমি কৃতজ্ঞ, কর্নেল। আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে গুলিটা আমার মাথায় লাগত। পেছনের ছবিটা চূর্ণ হওয়া দেখেই তা টের পাচ্ছি। কিন্তু ওদের এত সাহস হল কীভাবে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন—দুবৃত্তদের পক্ষে এমনটা স্বাভাবিক শংকর। কিন্তু আমি একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আততায়ীর গুলির লক্ষ্য ছিলে তুমি। অথচ ন্যাড়াকে যারা চুরি করেছে, তারা তোমাকে খুন করতে চাইবে কেন? তোমাকে মেরে ফেললে তো বাকসোটা পাবার আশাই আর থাকবে না। কাজেই মনে হচ্ছে, এই বাকসো-রহস্যের পেছনে আরও একটা দল রয়েছে।
শংকর অবাক হয়ে বললেন-তারা আবার কারা।
শিগগির সেটা খুঁজে বের করব। এখন বরং ওই খোলা জানলাটা বন্ধ করে দিই। এই শীতে ওটা খুলে রেখেছিলুম, বাইরের দিকটায় লক্ষ রাখার জন্য। এখন বুঝতে পারছি, কাজটা ঠিক করিনি। তাছাড়া এখন থেকে আমাদের পদে পদে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
বলে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে কর্নেল আরাম কেদারায় বসলেন। শংকর বারবার ভয়ে ভয়ে খোলা দরজার পর্দার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তা দেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন—না শংকর। আততায়ী যেই হোক, দরজা দিয়ে হামলা করার সাহস তার নেই। থাকলে সে দূর থেকে গুলি না ছুঁড়ে সোজা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই হামলা করত।
কিছুক্ষণ পরে পুলিশ সুপার অজিতেশ তার দলবল নিয়ে এসে পড়লেন। সব শুনে। বললেন—আমারই ভুল হয়েছে। বাংলোটা পাহারার ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। যাই হোক, সে-ব্যবস্থা করছি। এখন চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।
রাতের অন্ধকারে সবাই মিলে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশদল সতর্কভাবে চলল।
রেললাইন পেরিয়ে সেই পোড়ো মাঠে কিছুটা এগিয়ে ওঁরা জঙ্গলে ঢুকলেন। তখনও কেউ টর্চ জ্বালেননি। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তাতে প্রচণ্ড শীত। কুয়াশার মধ্যে আকাশের নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে। স্টেশনের দিকটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। বাতিগুলো আবছা জ্বলছে।
বটতলার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দেখাদেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন—কী একটা শব্দ হচ্ছে যেন।
শংকর ও অজিতেশ কান পেতে শুনে বললেন—হ্যাঁ।
কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তেমনি চাপা গলায় বললেন—একসঙ্গে সবগুলো টর্চ জ্বালতে হবে। রেডি। ওয়ান-টু-থ্রি।
একসঙ্গে প্রায় একডজন টর্চের আলো জ্বলে উঠল। সামনে দেখা গেল তিনটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে একমুহূর্ত হতচকিত হয়ে গিয়েছিল তারা। তারপর দৌড়ে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেল।
গুপ্ত কবরের পাথরের ঢাকনা সরানো হয়েছে। এবার গর্তের ভিতর থেকে এক লাফে একটা লোক প্রায় ডিগবাজি খেয়ে অন্ধকার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।
অজিতেশের নির্দেশে সেপাইরা সেই মুহূর্তেই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছে।
ওদিকে জঙ্গলে বারবার টর্চের ঝলক, বন্দুকের আওয়াজ কয়েকবার, তারপর পাকড়ো পাকড়ো চেঁচামেচি শোনা গেল।
কর্নেলরা কবরের কাছে দৌড়ে এলেন। এসে টর্চের আলোয় দেখলেন, গর্তের মধ্যে মৃতদেহের কফিনটা টেনে এনে রেখেছে। কফিনের ঢাকনা খোলা! তার ভেতরে একটা পোশাকপরা মৃতদেহ রয়েছে। বালকেরই মৃতদেহ। কিন্তু তার মুণ্ড নেই। কবন্ধ মৃতদেহটা মমি করা।
কর্নেল, শংকর আর অজিতেশ তিনজনেই কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর একসঙ্গে বলে উঠলেন, তাই তো।
তারপর কর্নেল গর্তে নামলেন। বহুক্ষণ ধরে মমিটা পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর বললেন—ফকির ঠিকই বলেছিল দেখছি। কে বা কারা মুণ্ডু কেটে নিয়ে গেছে, কিন্তু একথা ঠিক যে মুণ্ডুটা কাটা হয়েছে গত কয়েকদিনের মধ্যেই।
অজিতেশ বললেন—কীভাবে বুঝলেন?
কর্নেল হাসলেন। বললেন-খুব সোজা যুক্তি। শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে যাবার আগে মুণ্ডু কাটা হয়নি। তাহলে যে মুণ্ডু কেটেছে, সে কি বাকসোটা ফেলে রেখে যেত? কাজেই শংকরবাবু বাকসো নিয়ে যাবার পরই কাজটা করা হয়েছে।
অজিতেশ ও শংকর সায় দিয়ে বললেন—ঠিক, ঠিক।
কর্নেল বললেন-মুণ্ডু যে কেটেছে সে জানে বাকসো যেই হাতাক্, চাবি এই মুণ্ডের চুলের মধ্যে আছে। কাজেই তার উদ্দেশ্য হল, কাটা মুণ্ডুর চুল খুঁজে চাবি বের করা এবং বাকসোটা উদ্ধার করা।
শংকর বললেন—তাহলে একাজ কমলাক্ষেরই।
কর্নেল আনমনে বললেন—বলা কঠিন। দেখা যাক। তবে এস, মৃতদেহটা আমরা যথাস্থানে রেখে আগের মতো সমাধিস্থ করি। আর অজিতেশ, তুমি তোমার কথামতো আপাতত কিছুদিন এখানে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করো।