কর্নেল বললেন, কিন্তু কমলাক্ষবাবু তো আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পেয়ে গেছে। তা জানেন?
ফকির চমকে উঠে বলল—সাচ্ বাত?
হাঁ ফকিরসায়েব। এমনকী সে আজিমুদ্দিনের কবরের সেই কালো বাকসোটাও হাতিয়ে নিয়েছে।
ফকির ফের ক্রুর হেসে বলল-ফয়েদা হবে না। ও বাক্সের চাবি কঁহা সে মিলেগা?
কেন? আজিমুদ্দিনের মমিকরা লাশে—মানে তার চুলের মধ্যে লুকোনো আছে।
ফকির জোরে মাথা নেড়ে বলল—কবর ছুঁড়ে আমি দেখেছে। আজিমুদ্দিনের লাশের মাথা নেই। কৌন ডাকু কাট লিয়া।
কর্নেল চমকে উঠলেন। বলেন কী ফকিরসায়েব!
ফকির এবার শান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আজিমুদ্দিনকা শির যিকা পাস হ্যায়, চাবিভি উসকা পাস হ্যায়।
বলে ফকির ফের চোখ বুজল। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকল। তারপর সে আলখেল্লার ভেতর থেকে একমুঠো ধুনো বের করে আগুনে ছড়ালে। আগুনটা দপকে উঠল। তখন ফকির হঠাৎ গর্জে বলে উঠল—চলা যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!
কর্নেল সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, ফকির ফের আরেক মুঠো ধুনোর মতো কী জিনিস আগুনে ফেলল। কিন্তু এবার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল।
আগুনের কুণ্ড থেকে মুহূর্তে হু হু করে সাদা ঘন একরাশ ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। তার উৎকট গন্ধে কর্নেল তক্ষুনি পিছিয়ে এলেন। ওদিকে সেই ধোঁয়া বেশ কিছুক্ষণ হু-হু করে আকাশে ওঠার পর আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আগুনটাও নিভে গেছে ইতিমধ্যে। কর্নেল টর্চ জ্বেলে দেখলেন, ফকির অদৃশ্য।
এখানে ওখানে টর্চ জ্বেলে সমাধি এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে আর ফকিরকে দেখতে পেলেন
কর্নেল। তখন বিস্মিত মনে ফিরে এলেন রাস্তায়।
বাংলোয় ফিরে দেখলেন, গেটে শংকরবাবুর গাড়ি রয়েছে। শংকর তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেলকে দেখে শংকর একটু অবাক হয়ে বললেন- আপনাকে অমন দেখাচ্ছে। কেন? কী হয়েছে কর্নেল?
কর্নেল বললেন—বলছি। আগে চৌকিদারকে কফি করতে বলো, শংকর। বলে ঘরের দরজা খুলে আরামকেদারায় এলিয়ে পড়লেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।..
০৭. মুণ্ডহীন মমি
কিছুক্ষণ পরে কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তখন শংকর বললেন—কী হয়েছিল, বলবেন কর্নেল?
কর্নেল বললেন—বিষাক্ত গ্যাসের ঝঝে মাথা ঘুরছিল।
শংকর অবাক হয়ে বললেন—বিষাক্ত গ্যাস। কোথায় ছিল?
তখন কর্নেল এক ফকিরের সঙ্গে আচমকা দেখা হওয়া এবং যা যা ঘটেছে, সব বললেন। শেষে বললেন—বলতে পারো, ফকিরের সঙ্গে আজিমুদ্দিনের কবরের সম্পর্ক আছে, জানলুম কী করে? ওটা নেহাত আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কারণ কী জানো শংকর? আমি বরাবর দেখেছি, পিরের দরগার ফকিররা বংশানুক্রমেই ফকির এবং এলাকার প্রাচীন মুসলমান শাসকদের ইতিহাস তাদের মুখস্থ থাকে। তাই ওখানে জঙ্গলের মধ্যে পিরের দরগায় ওই ফকিরকে দেখে আমি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো আজিমুদ্দিনের কবরের কথা জিগ্যেস করলুম। ফলও পেলুম হাতে নাতে। তবে এই ফকিরবাবাজি দেখছি সাংঘাতিক লোক। ওর কাছে একরকম পাউডার আছে। তা আগুনে ছুঁড়লে মারাত্মক গ্যাস সৃষ্টি হয়। প্রাচীন হেকিমি শাস্ত্রে এই অদ্ভুত জিনিসটার কথা পড়েছিলুম! এবার স্বচক্ষে দেখলুম।
শংকর বললেন—একটা কথা বুঝতে পারছি না। আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা, তা জানলেন কী ভাবে?
অতি সাধারণ বুদ্ধিতে। কর্নেল একটু হাসলেন। দ্যাখো শংকর, মানুষের মৃত্যুর পর কয়েকদিনের মধ্যে চুল খসে যায়। কাজেই চুলের মধ্যে চাবি লুকিয়ে রাখার প্রশ্ন ওঠে তখন, যখন কি না চুল খসে পড়ার উপায় থাকে না। অর্থাৎ চুলসুদ্ধ মৃতদেহ মমি করা হলে, তবেই চুলের মধ্যে চিরকালের জন্যে চাবি লুকিয়ে রাখা যায়।
শংকর বিস্মিতভাবে বললেন—কিন্তু মমি করার প্রথা তো সেই মিশরের লোকেরা তিন-চার হাজার বছর আগে জানত! ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এদেশে মমি করার কথা তো শুনিনি!
কর্নেল বললেন-না শংকর। ওই প্রচলিত ধারণা একেবারে ভুল। আমাদের দেশে হিন্দুরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু মুসলমান ও খ্রিস্টানরা কবরে রাখে। প্রাচীন আমল থেকেই অনেক অভিজাতবংশীয় মুসলমান কিংবা রাজাবাদশাদের মৃতদেহ কবরে দেওয়ার আগে একরকম মশলা মাখানো হত। এক শ্রেণির লোক এই বিদ্যা জানত। তবে মিশরের মমির মতো এসব মমি হাজার হাজার বছর টিকত না। সচরাচর দুই থেকে পাঁচশো বছর অন্তত অক্ষত থাকত। কাজেই আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা হয়েছিল, তা স্বাভাবিক।
শংকর বললেন—পুলিশ সুপার অজিতেশের সাহায্যে আমরা প্রকাশ্যে ওই কবর খুঁড়ে দেখতে পারি, ফকিরের কথা সত্যি কি না। কর্নেল, কালই ব্যাপারটা দেখা যাক।
কর্নেল জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন—না শংকর। কবর প্রকাশ্যে খুঁড়তে গেলে এলাকার মুসলমানরা তাতে প্রবল আপত্তি করবেন। স্বধর্মীয়ের মৃতদেহ তারা অন্যধর্মের লোকেদের হাত ছোঁয়াতে দেবেন না। কাজেই ব্যাপারটা আজ রাতেই গোপনে সেরে ফেলতে হবে।
বাংলোয় ফোন রয়েছে। কর্নেল পুলিশ সুপারকে ফোনে কথাটা জানালেন। তারপর ফোন রেখে শংকরকে বললেন—অজিতেশ ঘণ্টাখানেক পরেই এসে পড়বে। তা শংকর, শ্রীমান ন্যাড়ার বাবা-মা নিশ্চয় ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
শংকর বললেন-তা আর বলতে!
তুমি কি ওদের সব কথা বলেছ?
না। তাহলে তো দিদি-জামাইবাবুকে সামলানো কঠিন হবে। কেউ ন্যাড়াকে আটকে রেখেছে কিংবা আমি সেই উড়ো চিঠি পেয়েছি—এসব কোনও কথা ঘুণাক্ষরে ওঁদের বলিনি। বলেছি—নিশ্চয় কলকাতা বেড়াতে গেছে একা। ও যা খেয়ালি ছেলে। একবার কিন্তু একা কলকাতা পালিয়েছিল, জানেন?