গাড়ি বাংলার গেটের পাশে রেখে তিনজনে সুরকি-বিছানো লন পেরিয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলেন। সেখানে বসে কর্নেল ও শংকর মোটামুটি ঘটনাটা পুলিশ সুপার অজিতেশের কাছে বর্ণনা করলেন।
সবটা শুনে অজিতেশ বললেন—আমার ধারণা, শংকরের ভাগনেকে চুরি করে ওরা কলকাতাতেই কোথাও রেখেছে। কাজেই ওকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সেখানকার পুলিশ দফতরেই যোগাযোগ করা দরকার। আর কর্নেল সাহেব তো এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। লালবাজারের পুলিশকর্তাদের সঙ্গে ওঁর প্রচণ্ড খাতির। তাছাড়া ওঁর নিজের ক্ষমতা ও বুদ্ধিও সামান্য নয়। তবে স্টেশনের ওপারে পোডড়া মাঠের জঙ্গলে মাটির তলায় যে কবরের কথা শুনলাম, তা পাহারার দায়িত্ব আমার রইল।
একদল সাদা পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ ওখানে আনাচে-কানাচে চব্বিশঘণ্টা ওত পেতে থাকবে। কাকেও বটতলায় গিয়ে কিছু করতে দেখলেই পাকড়াও করবে।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—কিন্তু আমি আর শংকর যে ওখানে গিয়ে হানা দিতে চাই। আমাদের ওপর তোমার লোকেরা, হামলা করলেই তো মুশকিল।
অজিতেশ বললেন—সে ব্যবস্থা করে রাখব। কর্নেল, আপনার চেহারা তো একেবারে সাহেবের মতো। আর শংকর আপনার সঙ্গে থাকবে। আমার লোকেদের সেটা বলে রাখব। কর্নেলকে চিনতে তাদের ভুল হবে না। তার উপর মাথায় টাক, মুখে দাড়ি।
আবার তিনজনে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে ট্রে ভর্তি খাবার ও কফি এল। দুপুরে খাওয়া পথেই সেরে নিয়েছিলেন। কথা বলতে-বলতে বিকেল হয়েছে। শীতও বেড়েছে। কফি খেয়ে চাঙ্গা হবার পর শংকর বিদায় নিলেন। উনি জামাইবাবুর বাড়ি থাকবেন। ইতিমধ্যে ফোন করে অজিতেশ কর্নেলের জন্য নদীর ধারে সুদৃশ্য বাংলোর ব্যবস্থা করে ফেললেন।
কিছুক্ষণ পরে অজিতেশ তার জিপে করে কর্নেলকে সেই বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে এলেন।
বাংলোয় দুটো ঘর। পাশের ঘরে এক সরকারি অফিসার এসেছেন। কর্নেলের ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। নিচে নদী। নদীর ওপারে ঘন বাঁশবনে ঢাকা একটা গ্রাম। রেললাইনটা বাংলোর পূর্বে। পুবের বারান্দায় দাঁড়ালে স্টেশনের ওধারে সেই পোডড়া মাঠের শেষে জঙ্গল ও বটগাছটা দেখা যায়।
শীতের দিন শিগগির ফুরিয়ে এল। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে সেই দূরের বটগাছটা দেখছিলেন। কুয়াশা ও আঁধারে সেটা ঢাকা পড়লে বাইনোকুলার রেখে এলেন ঘরে। শংকরের এখনই এসে পড়ার কথা।
আনমনে লনে পায়চারি করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন কর্নেল। মাথায় টুপি, পরনে ওভারকোট এবং হাতে ছড়ি নিয়েছেন। লিটনগঞ্জে শীতটা বড্ড বেশি পড়েছে এবার।
শংকর আসতে দেরি করছেন কেন? কর্নেল উদবিগ্ন হয়ে ঘড়ি দেখলেন। সওয়া ছটা বেজে গেল। ছটায় আসার কথা।
গেট খুলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই সময় একটু তফাতে কে চিৎকার উঠল—ইয়া পির মুশকিল আসান। যাঁহা মুশকিল তাহা আসান। তারপরই এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল।
কর্নেল চমকে উঠেছিলেন। পকেটে টর্চ আছে। কিন্তু জ্বাললেন না। দ্রুত আলো লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু আলোটা রাস্তার ধারে জ্বলছে না। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপঝাড়। তার ভেতর দেখা যাচ্ছে। তখন পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগিয়ে গেলেন।
যেখানে আলোটা জ্বলছে, সেখানটা একটা পিরের মাজার বলেই মনে হল। উঁচু চৌকানো পাথরে বাঁধানো বেদির মতো একটা চত্বর রয়েছে। তার পাশে একটা প্রকাণ্ড কাঠমল্লিকা গাছ। গাছের তলায় আগুনের কুণ্ড জ্বেলে বসে আছে এক ফকির।
ফকিরের পরনে কালো আলখেল্লা। গলায় অজস্র পাথরের মালা। মাথায় কালো পাগড়ি। তার কোলে একটা প্রকাণ্ড লোহার চিমটে রয়েছে। ফকির চোখ বুজে বসে বিড়বিড় করে কী মন্তর আওড়াচ্ছে আর আগুনে ধুনো ছড়াচ্ছে। তখন আগুনটা হু হু করে জ্বলে উঠছে।
কর্নেল গিয়ে সামনে দাঁড়ালে ফকির চোখ খুলল। তারপর নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তখন কর্নেল বললেন—সেলাম ফকিরসায়েব।
ফকির এবার মৃদু হেসে সামনে বসতে ইশারা করল।
কর্নেল বললেন—ফকিরসায়েব কি এই পিরের মাজারের (সমাধির) সেবক?
ফকির জবাব দিল, হ্যাঁ বেটা। লেকিন তুম কঁহাসে আয়া? চেহারা দেখে মালুম হচ্ছে কি, তুমলোক আংরেজ সাহাব আছ। লেকিন বাংলায় বাত ভি বলছ। তাজ্জব!
আমি ইংরেজ পুরো নই, ফকিরসাহেব। অর্থেক ইংরেজ, অর্ধেক বাঙালি।
তাজ্জব! ক্যায়সে?
আমার বাবা বাঙালি ছিলেন। মা ইংরেজ ছিলেন।
ফকির হেসে উঠল। তব্ বেটা, তুম অ্যাংলো-ইন্ডিয়েন আছে, তো ঠিক হ্যায়! বোলো, ক্যা মাংতা মেরা পাস? হামার কাছে কী চাও?
কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ফকিরের পায়ের কাছে রাখলেন। ফকির অমনি খপ করে সেটা তুলে নিয়ে আলখাল্লার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল। তার চোখে লোভের আনন্দ চকচক করছিল। ফিসফিস করে বলল—বোলো বেটা, ক্যা মাংতা তুম?
কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন-ফকিরসায়েব, আপনি তো সিদ্ধপুরুষ। বলুন তো জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ-আল-তামাসের ছেলে আজিমুদ্দিনের কবর কোথায় আছে।
অমনি ফকির নড়ে উঠল। তার চোখে আগুন ঠিকরে বেরুতে থাকল যেন। সেই দশ টাকার নোটটা বের করে বলল—ইয়ে লো তুমহারা রূপেয়া! নিকাল যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!
কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, সে কী ফকিরসায়েব! চটে যাচ্ছেন কেন?
ফকির ক্রুদ্ধস্বরে বলল—দেখো, ইয়ে টাউনকা কমলাবাবুনে বহত দফে হামার কাছে এসেছে ঔর এহি বাত পুছেছে। হামি বোলে নাই। কিসিকো হাম ইয়ে ছুপা বাত (গুপ্ত) বলবে না। কমলাবাবু হামাকে খুন করতে ভি এসেছিল। তো আমি এইসা জাদুকা খেল জানে, কমলা জান লিয়ে ভেগে গিয়েছিল। বলে ফকির হিংস্র মুখে ক্রুর হাসি হাসল।