যাই হোক, কমলাক্ষ ও মাধব আগের দিন সন্ধ্যায় মাটির তলার কবরে কালো বাকসোটা আর দেখতে পাননি। এখন ন্যাড়ার মুখে সব জেনে তিনি তো মনে মনে রেগে আগুন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না।
ন্যাড়া বলেছিল—হ্যাঁ কাকু, কালো বাকসোটা তোমরা ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলে কেন গো?
কমলাক্ষ চেপে গেলেন। আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল এই : লিটনগঞ্জে পিরের দরবারে ফকিরের কাছে কিছু টাকার বিনিময়ে এমন ঘটনার আভাস পেয়েছিলেন কমলাক্ষ। সেই সূত্র ধরে আজিমুদ্দিনের কবর খুঁজে বের করেছিলেন। বাকসোটাও পেয়েছিলেন, কিন্তু বাকসোটা কিছুতেই। খুলতে বা ভাঙতে পারেননি। মাধবও অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে দুজনে ঠিক করেছিলেন, আপাতত যেখানে বাকসোটা ছিল সেখানে থাক। ইতিমধ্যে বিদেশি কোনও ধাতুবিদ্যা বিশারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাক। তারপর একদিন বাকসোটা তার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে
কিন্তু হঠাৎ ন্যাড়ার ছোটমামার পাল্লায় পড়ে সেটা বেহাত হয়ে গেল।
এ সেদিন ন্যাড়া তাদের বাড়ি ঢুকলে কমলাক্ষ গেলেন মাধবের কাছে। মাধব সব শুনে খেপে গেল। সে বলল—এক কাজ করা যাক্ কমলদা। ওই ক্ষুদে বজ্জাতটাকে আমরা চুরি করে লুকিয়ে রাখি। তারপর বেনামী চিঠি দিই হারামজাদা শংকরচন্দ্রটাকে।
বাধা দিয়ে কমলাক্ষ বলেছিলেন—উঁহু ন্যাড়ার বাবাকেই উড়ো চিঠি দিতে হবে। ছেলের জন্য মমতা বাবারই বেশি হবে। বুঝলে না?
এরপর দুজনে চক্রান্ত করে ন্যাড়াকে চুরির ফিকিরে বেরিয়েছিল।
আপনভোলা ছেলে ন্যাড়া সন্ধ্যার আগে ঘুড়ি উড়িয়ে ফিরে আসছে, তার সামনে একটা জিপগাড়ি দাঁড়াল। মাধবের চোখে কালো চশমা। শীতের সময় বলে টুপিতে মুখের ও মাথার অনেকটা ঢাকা। সে ড্রাইভ করছিল। কমলাক্ষ ডাকলেন—নেড়ু! বাড়ি চললি বুঝি? আয়, জিপে করে পৌঁছে দিই।
ন্যাড়া জিপে উঠতেই কমলাক্ষ তার নাকের সামনে রুমাল চেপে ধরল। উগ্র কী এক ঝাঝালো গন্ধ টের পেল ন্যাড়া। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
যখন তার জ্ঞান ফিরল, সে দেখল একটা অচেনা ঘরে শুয়ে আছে। পাশে বসে আছেন কমলাক্ষ। মুখে অমায়িক হাসি।
ন্যাড়া ওঠার চেষ্টা করতেই বললেন—উঁহু, উঠো না! উঠো না!
ন্যাড়া বলল—কেন? আমার কী হয়েছে?
অ্যাকসিডেন্ট! কমলাক্ষ বললেন। তোমাকে জিপে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলুম, মনে পড়ছে?
ন্যাড়া বলল—হ্যাঁ, হ্যাঁ।
পথে আমাদের জিপ উলটে যায়। ভাগ্যিস, আমি ছিটকে পড়েছিলুম। বেঁচে গেছি। তুমিও বেঁচে গেছ। তবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে!
আমি তো ভালো আছি। আমার কিছু হয়নি!
হয়েছে। চুপ করে শুয়ে থাকো।
ন্যাড়া উঠে বসে বলল—না। আমি বাড়ি যাব।
অমনি কমলাক্ষ আচমকা একটা ছুরি বের করে বললেন—চুপ টু শব্দ করলে মুণ্ডু কেটে ফেলম। চুপ করে শুয়ে থাকো।
কমলাক্ষের হিংস্র চেহারা দেখে ন্যাড়া ভয়ে অবশ হয়ে গেল। এই সময় মাধব ঘরে ঢুকে বলল—কথা না শুনলে ওর হাত-পা বেঁধে রাখতে হবে কমলদা।
কমলাক্ষ নিষ্ঠুর হেসে বললেন—দরকার হবে না। নেড়ু বড় ভালো ছেলে। আর নড়াচড়া করলে ওকে শ্রীমান ডালকুত্তার জিম্মায় রেখে দেব। কই হে মাধব, তোমার প্রিয় ডালকুত্তা জনকে একবার নিয়ে এস।
ন্যাড়া আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল, মাধব কোনার দিক থেকে একটা ভয়ংকর চেহারার ডালকুত্তাকে এনে তার বিছানার খাটের একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখল। ডালকুত্তাটা কুৎসিত জিভ বের করে কুতকুতে হিংস্র চোখে ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
মাধব বলল—একটু নড়তে চেষ্টা করলে জন তোমার গলায় দাঁত বসাবে। সাবধান।
কমলাক্ষ বললেন-ঠিক আছে। এবার আমরা নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ি, চলো মাধব!
দুজনে বেরিয়ে গেল। বাইরে দরজায় তালা আটকানোর শব্দ শুনল ন্যাড়া। সে নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে রইল। পায়ের দিকে রাক্ষুসে প্রাণীটা নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটু নড়লেই গর্জন করে টুটি কামড়ে ধরবে।
কমলাক্ষকাকু যে এমন শয়তান, ন্যাড়া কোনওদিন কল্পনাও করেনি।…
০৬. ফকিরের বুজরুকি
লিটনগঞ্জে পৌঁছে কর্নেল কিন্তু শংকরবাবুর সঙ্গে ন্যাড়াদের বাড়ি গেলেন না। বললেন—এখানকার পুলিশ সুপার অজিতেশ আমার পরিচিত। আমি ওঁর সাহায্যে সরকারি ডাকবাংলোতেই থাকার জায়গা করে নেব। আপনি ভাববেন না শংকরবাবু।
সরকারি আপিস এলাকায় পুলিশ সুপারের বাংলো। শংকরবাবুর গাড়ি তার গেটে দাঁড়াল। কর্নেল গেট খুলে ভেতরে গেলেন।
একটু পরে শংকরবাবু দেখলেন, পুলিশ সুপার আর কর্নেল কথা বলতে বলতে আসছেন গেটের দিকে।
কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই পুলিশ সুপার অজিতেশ বলে উঠলেন—আরে তুমি শংকর না?
শংকরবাবুও লাফিয়ে উঠলেন—অজু! তুমি! কী আশ্চর্য! তুমি যে আমার জামাইবাবুর এলাকায় পুলিশের বড়কর্তা সেজে বসে আছ, স্বপ্নেও ভাবিনি! তুমি সেই বালুরঘাটে না কোথায় ছিলে না। এখানে বদলি হলে কবে?
অজিতেশ বললেন—সবে দু সপ্তাহ। যা গে চলে এস। এ বেলা আর জামাইবাবুর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। কী বলেন কর্নেল?
কর্নেল এতক্ষণ হাঁ করে চেয়েছিলেন। এবার বললেন—ডার্লিং অজিতেশ! শংকরবাবু—থুড়ি, শ্রীমান শংকর নিশ্চয় তোমার সহপাঠী ছিল ছাত্রজীবনে?
অজিতেশ বললেন—হা কর্নেল। আমরা দুজনে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তুম।
যা গে। তাহলে শংকরকে তুমি বললে, দোষ হবে না। কর্নেল সকৌতুকে বললেন। তারপর অভ্যাসবশে দাড়িতে ও টাকে একবার করে হাত বুলিয়ে নিলেন।