শংকরবাবু ব্যস্তভাবে বললেন—আছে, আছে। তবে সেটা তো বেসরকারি সংগ্রহশালা। কমলাক্ষ বাঁড়ুয্যে নামে এক ভদ্রলোকের বেজায় ঐতিহাসিক বাতিক আছে। বলতে গেলে সংগ্রহশালাটা ওঁর চেষ্টাতেই হয়েছে। এলাকা খুঁজে নানারকম প্রাচীন মূর্তি, দলিল-দস্তাবেজ জোগাড় করেন উনি।
কর্নেল বললেন—হুম! চলুন, আজই আমরা লিটনগঞ্জ রওনা দিই। কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে আলাপ করা খুব দরকার।
শংকরবাবু অবাক হয়ে বললেন—কিন্তু ন্যাড়ার উদ্ধারের কী হবে? ওরা যে আজ আর আগামীকাল পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন-ভাববেন না। ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাকসো পাওয়া। ন্যাড়াবাবাজিকে মেরে ফেলাটা তো উদ্দেশ্য নয়। ওরা ভালোই জানে, ছেলেটাকে মেরে ফেললে আপনারা বাকসোটা সোজা পুলিশের হাতে দেবেন। আমি অপরাধীদের চরিত্র নিয়ে বহুকাল ঘাঁটাঘাঁটি করছি, শংকরবাবু। ওরা যদি নিছক টাকা দাবি করত, তাহলে ভাবনার কথা ছিল। আসল কথা, ওরা চায় বাকসোটা। কাজেই নিশ্চিন্ত থাকুন। তাছাড়া আগামীকাল বিকেলের মধ্যে আমরা ফিরে আসছি।
কথা বলতে বলতে কর্নেল এগিয়ে পশ্চিমের একটা জানলা একটু খুলে উঁকি দিলেন। তারপর খে বাইনোকুলার রেখে বললেন—হুম! ওরা আপনার বাড়ির দিকে নজর রেখেছে।
সে কী! বলে শংকরবাবু কাছে গেলেন। কর্নেল তাকে বাইনোকুলারটা দিলে তাতে চোখ রেখে শংকরবাবু বললেন—গঙ্গার ঘাটে যে লোকটা ছিপ ফেলে বসে আছে, সেই কি?
ঠিক ধরেছেন। কর্নেল সরে এলেন। তারপর বললেন—বাকসোটা যথাস্থানে লুকিয়ে ফেলুন। তারপর চলুন, এখনই বেরিয়ে পড়া যাক!
বাকসোটা আগের জায়গায় রেখে ছবিটা ঠিকঠাক করে আলো নিভিয়ে শংকরবাবু জানালাগুলো খুলে দিলেন। পশ্চিমে একবার উঁকি মেরে বললেন- ছিপ নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে, কর্নেল।
যাক গে। আপনি রেডি হয়ে নিন শিগগির। আর হ্যাঁ, অনুবাদের কাগজটা আমাকে দিন। ওটা পুড়িয়ে ফেলা দরকার।
শংকরবাবু বেরিয়ে গেলেন কাগজটা দিয়ে। হারাধনকে খাওয়ার আয়োজন করতে বলবেন। এদিকে কর্নেল কাগজটা পুড়িয়ে ছাইদানিতে গুঁজে দিলেন।
একটু পরে হারাধন ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। শংকরবাবু এসে বললেন—পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। কাজেই পেটপুরে খেয়ে নিন কর্নেল!
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—আমি তত ভোজনবিলাসী নই। আপনার হারাধন দেখছি দশজন পালোয়ানের খাবার এনেছে।
হারাধন একগাল হেসে বলল-তা আজ্ঞে, আপনার যা পালোয়ানি চেহারা, ওটুকুন আপনার এক গেরাস মাত্তর।
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন …
০৫. কমলাক্ষের শয়তানি
ন্যাড়া মোটামুটি বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু সে ভারি সরল। সেটাই তার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরদিন সকালে ছোটমামু শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। ন্যাড়া স্টেশনে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছে, পথে কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি হন হন করে আসছিলেন। পাড়াসম্পর্কে কাকা বলে ন্যাড়া। তাই বলেছিল—ও কাকু। ট্রেন যে এইমাত্তর ছেড়ে গেল!
কমলাক্ষ থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন-যাঃ! তাহলে আর কী হবে? ওবেলা যাবখন। আয় বাবা নেড়ু তোর সঙ্গে গল্প করতে করতে যাই।
সেই সময় হঠাৎ ন্যাড়ার মনে চমক খেলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় যে দুটো লোক মাটির তলার ওই কবর খুঁড়তে গিয়েছিল তাদের একজনের গলার স্বর অবিকল কমলাক্ষের মতো না? ন্যাড়া বলেছিল—হা কাকু, তোমার জাদুঘরে যেসব জিনিস রেখেছ, সেসব কোথায় পেয়েছ গো?
কমলাক্ষ বলেছিলেন—ওসব খুঁজে বের করতে হয় রে। অনেক মেহনতের কাজ। ধরু, অনেক সময় মাটির তলাতেও পাওয়া যায়।
ন্যাড়া বলে উঠেছিল—ও কাকু, তাহলে সেদিন সন্ধেবেলা স্টেশনের ওপারে বটতলায়…
অমনি কমলাক্ষ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিলেন—চুপ, চুপ। কাকেও বলিস নে। তা হা রে, তুই কীভাবে জানলি?
ন্যাড়া ফিক করে হেসে বলেছিল—বা রে! তখন আমি গাছের ডালে আটকানো ঘুড়ি পাড়ছিলুম না? তোমাদের কাছে বন্দুক ছিল। তাছাড়া চিনতেও পারিনি। তাই সাড়া দিইনি!
সর্বনাশ! কমলাক্ষ বলেছিলেন। তা এখন চিনলি কী করে?
তোমার গলার স্বরে।
তুই ভারি বুদ্ধিমান ছেলে, নেড়ু। তা হা রে, কাকেও বলেছিলি নাকি কথাটা?
হুঁউ। ছোটমামাকে।
তারপর, তারপর?
সরলমনা খামখেয়ালি ছেলে ন্যাড়া ছোটমামার নিষেধ ভুলে সব কথা বলে ফেলল। কিন্তু ধূর্ত কমলাক্ষের এটা নিতান্ত ছল। আগের দিন সন্ধেবেলা জঙ্গলে বাকসো নিয়ে পালানোর সময় আবছা একপলক তিনি দেখেছিলেন, দুটো লোক জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের একজন বয়সে বাচ্চা। কিন্তু সে যে ন্যাড়া হতে পারে, ভাবেননি তখন। পরে, ওই মাঠে যেসব ছেলে খেলা করতে যায়, তাদের প্রত্যেকের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন, একটা বয়স্ক লোক আর একটা কমবয়সি ছেলেকে কাল সন্ধ্যার আগে ওখানে কেউ দেখেছিল নাকি। হরিহর উকিলের ছেলে সতু বলেছিল, ন্যাড়া হতে পারে। ন্যাড়ার ঘুড়ি প্রায় আটকে যায় বটগাছটায়। আর হা, কাল তার সঙ্গে কে একজন অচেনা লোকও ছিল।
কমলাক্ষের সঙ্গীর নাম মাধব। লিটনগঞ্জে লোকে তাকে বলে মেধোগুন্ডা। কমলাক্ষ তার সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের অছিলায় প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক মূর্তি সংগ্রহ করেন এবং মাধবের সাহায্যে তা বিদেশে বিক্রি করেন। আজকাল ওসব পুরনো মূর্তি বা জিনিসের চোরাচালানি কারবার চলছে দেশ বিদেশে। কাজটা বেআইনি। হংকং শহরে এক ব্যবসায়ী এই কারবার করে। তার এজেন্ট আছে কলকাতায়। মাধবের সঙ্গে সেই এজেন্টের যোগাযোগ আছে। এভাবে কমলাক্ষ কত প্রত্নদ্রব্য যে মাধবের সাহায্যে পাচার করেছেন, ইয়ত্তা নেই। কমলাক্ষ ও মাধব সেই টাকা আধাআধি ভাগ করে নেন। পুলিশ টের পায় না। কারণ ওই সংগ্রহশালা! সারা দেশের পণ্ডিতরা কমলাক্ষের ব্যক্তিগত চেষ্টায় গড়ে তোলা জাদুঘরের কত প্রশংসা করেন। মন্ত্রীরাও কতবার দেখে যান। কিন্তু তার জাদুঘরে নেহাত মামুলি কিছু পুরোনো দলিলপত্তর, কিছু পোড়ামাটির মূর্তি বা মুদ্রা ছাড়া তত দামি কিছু নেই। যা দামি, তা তো পাচার হয়ে যায়। আসলে কমলাক্ষের চোরাচালানি কারবারের একটা অজুহাত হল ওই জাদুঘর।