কর্নেল চোখ বুজে কী ভাবছিলেন। শুধু বললেন—হুম!
ডানলপ ব্রিজ ছাড়িয়ে আরও দু-কিলোমিটার এগিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট রাস্তায় গাড়ি মোড় নিল। তারপর সামনে একটা গেট দেখা গেল। ওটা শংকরবাবুর পৈতৃক বাড়ি, অমর নিকেতন।
গঙ্গার ধারে বিশাল এলাকা জুড়ে এই বাড়ি। বাগান রয়েছে। ফুল বাগিচা আছে। আগের আমলে বনেদি বড়লোকের বাড়ি যেমন ছিল তেমনি। গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াল।
০৪. রহস্য আরও ঘনীভূত
শংকরবাবুর বেডরুম দোতলার পুব-দক্ষিণ কোণে। অবিবাহিত মানুষ। বাড়িতে লোক বলতে উনি, ওঁর দূর সম্পর্কের এক পিসিমা যোগমায়াদেবী, আর রাঁধুনি সিধু ঠাকুর, বাজার সরকার মদনবাবু, চাকর হারাধন। হারাধন বুড়ো হয়ে গেছে। শংকরবাবুকে একরকম কোলেপিঠে করে সেই মানুষ করেছে। বাইরের কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না ওঁদের মধ্যে মনিব-চাকর সম্পর্ক।
কর্নেল ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন-আপনিও কি শিকারি?
শংকরবাবু হেসে জবাব দিলেন—হা। ওটা তিন-পুরুষের নেশা বলতে পারেন। তবে আজকাল তো দেশ থেকে বনজঙ্গল প্রায় উজাড়! জন্তুজানোয়ারও বিশেষ নেই-টেই। যা কিছু আছে, তা সরকারি অভয়ারণ্যে বাস করছে। কাজেই আজকাল শিকারে যাওয়া হয় না।
কর্নেল বললেন—যা গে। এবার সেই বাকসোটা বের করুন।
শংকরবাবু ঘরের দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করে দিলেন আগে। তারপর সুইচ টিপে বাতি জ্বাললেন। একপাশের দেয়ালে লম্বা-চওড়া একটা ছবি টাঙানো আছে। বিলিতি চিত্রকরের আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ছবিটা একটু ঠেলে একটা খুদে বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের প্রায় দু-ফুট লম্বা এক ফুট চওড়া একটা অংশ ছোট্ট কপাটের পাল্লার মতো খুলে গেল। তখন ভেতরে হাত ভরে কালো একটা বাকসো বের করে আনলেন।
ফের বোতাম টিপে দেওয়ালের গুপ্ত খোঁদলটা আগের মতো ছবিচাপা দিলেন। বাকসোটা টেবিলে এনে রাখতেই কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন সেটার দিকে। বললেন—এই সেই বাকসো?
হ্যাঁ কর্নেল। এই সেই আজগুবি বাকসো।
কর্নেল টেবিলল্যাম্পের সুইচ টিপে বাকসোটা দেখতে দেখতে তার মুখে প্রচণ্ড বিস্ময় ফুটে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন—আশ্চর্য! আশ্চর্য!
শংকরবাবু বললেন-কী আশ্চর্য কর্নেল?
শংকরবাবু, মনে হচ্ছে এটা একটা ঐতিহাসিক বাকসো। এর গায়ে খুব ছোট হরফে ফারসিভাষায় কী সব লেখা আছে। আমি ফারসিভাষাটা মোটামুটি জানি। একসময়ে ইরানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদ্রোহী একদল কুর্দ উপজাতির হাতে বন্দি হয়েছিলাম। কুর্দদের মাতৃভাষা ফারসির অপভ্রংশ কুর্দিস্তানি। কিন্তু তারা ফারসিও ভালো জানে। যাই হোক, পরে ব্রিটিশ সেনারা আমাকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু মাঝখান থেকে কুর্দিস্তানি আর ইরানি অর্থাৎ ফারসি আমার শেখা হয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলছি শংকরবাবু, সংস্কৃত ও ফারসি কিন্তু আর্যজাতির ভাষার গোষ্ঠীতে যমজ ভাই-বোন বলতে পারেন। এ দু-ভাষায় বিস্তর শব্দ একরকম। তাদের মানেও এক।
কর্নেলের এই বকবক করা বদ অভ্যাস। শংকরবাবু শুনেছিলেন, এ বুড়ো না জানে এমন কোনো বিষয় নেই। যাই হোক, শংকরবাবু উৎসাহ দেখিয়ে বললেন-তাহলে ওতে কী লেখা আছে, বলুন তো কর্নেল?
কর্নেল আতস কাচের সাহায্যে বাক্সের লেখাগুলো পড়তে পড়তে বললেন—আমি অনুবাদ করে যাচ্ছি বাংলায়। আপনি লিখে নিন।
শংকরবাবু একটা প্যাডে লিখতে শুরু করলেন।
১০০০ হিজরি সনে পরম প্রতাপশালী জায়গিরদার মইনুদ্দিন শাহ আল-তামাসের একমাত্র পুত্র আজিমুদ্দিন করুণাময় ঈশ্বরের আহ্বানে মাত্র দ্বাদশ বর্ষ বয়সে স্বর্গধামে প্রস্থান করিলেন। তাহার শোকগ্রস্ত বৃদ্ধ পিতা মিশর হইতে এক সাধকের আশীর্বাদস্বরূপ যে অগণিত রত্ন পাইয়াছিলেন, তাহা এই কৃষ্ণবর্ণ ধাতুনির্মিত পেটিকায় রাখিয়া স্বর্গীয় বালকের সমাধিতে যাপন করিলেন।
কিন্তু এই পেটিকা এক মহাতপস্বী অলৌকিক শক্তিধর ফকিরের মন্ত্রপূত। যে ইহা হরণ করিবে, তাহারই সর্বনাশ ঘটিবে। অতএব হে ঘৃণ্য তস্করবৃন্দ! হুশিয়ার। ইহা স্পর্শ করিও না।…
সুকৌশলে নির্মিত এই পেটিকা এমন এক ধাতুতে নির্মিত যে ইহা কোনোভাবেই খোলা যাইবে না। ইহা ভাঙাও অসম্ভব। অতএব, হে লোভী মানুষ! বৃথা সে-চেষ্টা করিও না।…
এই পেটিকার একস্থলে প্রায় অদৃশ্যে ছুঁচের ন্যায় একটি ছিদ্র আছে। সেই ছিদ্রপথে ইহার চাবি প্রবেশ করাইলে তবেই ইহা খোলা সম্ভব। চাবিটি স্বর্গীয় বালকের কেশের মধ্যে লুকোনো রহিল।
কিন্তু হুশিয়ার! পুণ্যাত্মা বালকের মৃতদেহ স্পর্শ করিও না। ফকিরের অভিশাপ হইতে রক্ষা পাইবে না।…
লেখা শেষ করে শংকরবাবু কর্নেলের মুখের দিকে তাকালেন। কর্নেল তখনও বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছেন। শংকরবাবু বললেন—১০০০ হিজরি সন কত খ্রিস্টাব্দ কর্নেল?
কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন—১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। বাংলায় তখন তুর্কি সুলতানের রাজত্ব। কিন্তু লিটনগঞ্জের ওই পোড়ো মাঠে জঙ্গলের মধ্যে মাটির তলায় কবরের হদিস পেল কে? কীভাবে পেল?
হুম! সেটাই ভাববার কথা। শুধু তাই নয়, আজিমুদ্দিনের কবরে যে এমন গুপ্তধন আছে, তার খববই বা সে কেমন করে জোগাড় করল?
ন্যাড়া বলছিল, একা নয়—দুজন ছিল।
হুম বলে কর্নেল কী যেন ভাবতে থাকলেন। তারপর হঠাৎ নড়ে উঠলেন। বললেন—আচ্ছা শংকরবাবু, লিটনগঞ্জ তো আপনার চেন; জায়গা। ওখানে কি কোনও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা আছে?