হঠাৎ তিনজনেই থমকে দাঁড়ালেন। একটা আলো জ্বলে উঠল কোথাও। হয়তো ওই ঘরের মধ্যেই দরমাবেড়ার দেয়ালের কোনও ফাটল দিয়েই আলোটা দেখা যাচ্ছে বুঝি।
পা টিপে টিপে তিনজনে আলোটা লক্ষ করে এগুতে থাকলেন। সেই সময় কী একটা জন্তু দৌড়ে পালিয়ে গেল ঝোপঝাড় ভেঙে। শেয়াল-টেয়াল হেবে। দরমাবেড়ার ঘরগুলোর পেছনে ঘন ঝোপ গজিয়েছে। সেই ঝোপে ঢুকে একটা ফাটলে কর্নেল উঁকি মারতে যাচ্ছেন, এমন সময় ঘরের ভেতর চাপা গলায় কে কথা বলে উঠল-লতিফ খা! তোমায় এখনও সাবধান করে দিচ্ছি, পবিত্র ওই মণি তোমার পাপের হাতে ছোঁবার চেষ্টা কোরো না। সর্বনাশ হবে!
কী অবাক! এ তো সেই পিরের মাজারের জাদুকর ফকিরের গলা!
দরমাবেড়ার দেয়ালের অবস্থা আঁঝরা। এখন তিনজনে তিনটে ফাটলে চোখ রেখেছেন। ভেতরে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন।
কালো আলখাল্লাধারী ফকির দাঁড়িয়ে আছে মেঝেয়। তার সামনে উবু হয়ে বসে আছে হেকিম লতিফ খাঁ। তার চোখেমুখে একটা ক্রুর ভঙ্গি। তার হাতের কাছে সেই ঐতিহাসিক কালো পেটিকা বা ছোট্ট বাকসোটা রয়েছে।
আর তার চেয়েও সাংঘাতিক, পেটিকার পাশে আজিমুদ্দিনের মমি-মুণ্ডুটা রয়েছে।
হেকিমের হাতে একটা সুচের মতো সূক্ষ্ম মিহি জিনিস। সে ফকিরের কথার জবাবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। –এ আমার বংশের সম্পদ। আমারই প্রাপ্য; ওসব ভয় আমায় দেখিও না। তাছাড়া তুমি তো বাপু সংসারত্যাগী ফকির, তোমার এসব বাজে ব্যাপারে নাক গলানোর দরকারটা কী? যাও! এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও! নৈলে তোমাকেও জবাই করে ফেলব!
বলে লতিফ খাঁ বাঁ হাতে একটা মস্ত ছোরা বের করে উঁচিয়ে ধরল।
ফকির এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল—আমি জানি তুমি তা পারবে। তুমি ছদ্মবেশী শয়তান! জায়গিরদার বংশের কলঙ্ক তুমি! কিন্তু এখনও সাবধান করে দিচ্ছি লতিফ খাঁ, ওই মণি স্বর্গের বস্তু। মিশরের সাধক আজমশাহ কঠোর সাধনায় ওই রত্ন আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন এক দেবদূতের কাছে। দোহাই তোমার, যদি বাঁচতে চাও-পেটিকা খুলো না!
লতিফ খাঁ বাঁকা হেসে বলল—এটার মধ্যে নিছক একটা নীলকান্ত মণি আছে—পুরুষানুক্রমে আমরা শুনে আসছি। কিন্তু কেউ আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পায়নি বলেই মণিটা হাতাতে পারেনি! এতদিনে আমার পূর্বপুরুষের সম্পদ আমি হাতিয়েছি। তুমি…
বাধা দিয়ে ফকির বলল—কিন্তু কবরের সন্ধান আমিই তোমায় দিয়েছিলুম লতিফ খাঁ! ওঃ! কী ভুলই না করেছিলুম!
লতিফ খাঁ বলল—কীসের ভুল? তুমি ঠিকই করেছিলে! কিন্তু মাঝখানে ব্যাটা কমলাক্ষ কী ভাবে টের পেয়ে বাগড়া দিয়েছিল। তাকে তো এবার পুলিশ ধরবেই! ইতিমধ্যে মণিটা নিয়ে আমি ইরানে পালিয়ে যাব। তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও, বলো। হা—তোমাকে আমি এই মণিবেচার টাকার কিছু ভাগ দিতে রাজি আছি।
ফকির বলল-লতিফ খাঁ! বাচালতা কোরো না। আবার বলছি, তুমি ওই মমি-মুণ্ডু আর বাকসো কবরে রেখে এস গে। ওঠো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। কবরের ওখানে পুলিশ সারাক্ষণ–পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি এরকম বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি করতে জানি। সেই ধোঁয়ার দাপটে পুলিশ দূরে সরে যাবে। সেই সুযোগে ঝটপট দুজনে কবরের মধ্যে এগুলো রেখে আসব।
লতিফ খাঁ তেমনি বিদঘুটে খ্যাক খ্যাক হাসি হেসে হেসে বলল—চুপ! এই দেখো, তোমার সামনেই আমি পেটিকা খুলছি। আমার পূর্বপুরুষের ঐশ্বর্য দেখে চোখ দুটো সার্থক করো, ফকিরসায়েব!
বলে সে সুচের মতো চাবিটা বাক্সের একস্থানে চেপে ধরল। ফকির দু হাত তুলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—লতিফ খা! সাবধান!
কর্নেল, অজিতেশ ও শংকর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। অবাক হয়ে এবার দেখলেন, কালো পেটিকার ওপরের অংশ আস্তে আস্তে ঠেলে উঠছে। তার এক বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকল।
পেটিকার ফাঁক দিয়ে অত্যুজ্জ্বল নীল আভা ঠিকরে বেরুতে লাগল। ঘরের ভেতর নীল তীব্র আলো পড়তে থাকল।
আবার ফকিরের চিৎকার শোনা গেল—হুঁশিয়ার লতিফ খাঁ! পালিয়ে এস! পালিয়ে এস!
তারপর ফকির এক লাফে বাইরে গিয়ে পড়ল। আর পেটিকার ওপরের অংশ খাড়া হয়ে ওঠার পর দেখা গেল, গোলাকার একটুকরো নীল উজ্জ্বল বস্তু রয়েছে ভেতরে এবং ঘরের ভেতরে সুতীব্র নীল আলোর ঝলকানি। লতিফ খাঁ দুচোখে আতঙ্ক ঠিকরে পড়ছে। সে স্থির হয়ে গেছে।
তারপর ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। নীল মণিটা একটু করে শূন্যে ভেসে উঠতে থাকল। কিন্তু লতিফ খাঁ তেমনি স্থির। যেন নীলরঙের একটা মমি হয়ে গেছে সে।
নীল মণিটা এবার শূন্যে ভেসে দরজার দিকে চলল। বাইরে ফকিরের চিৎকার শোনা গেল ফের—হুশিয়ার! হুশিয়ার!
কর্নেল, অজিতেশ আর শংকর একলাফে ঘরের সামনের দিকটায় চলে গেলেন। তারপর দেখলেন, নীলবর্ণ উজ্জ্বল সেই মণি নক্ষত্রের মতো ভেসে চলেছে ভাটার ওপর। সারা এলাকা তীব্র নীল বৈদ্যুতিক আলোয় ভরে গেছে।
তারপর হঠাৎ মণির গতিবেগ বাড়ল। হু হু করে আকাশে উঠে পড়ল। তারপর প্রচণ্ড বেগে নক্ষত্রের দিকে উড়ে চলল। দেখতে দেখতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা আকাশের নক্ষত্রলোকে মিলিয়ে গেল। আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক।
তিনজনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। এবার কর্নেল বলে উঠলেন— লতিফ খাঁর সাড়া নেই কেন? বলে টর্চ জ্বেলে ঘরের ভেতর আলো ফেললেন।
লতিফ খাঁ তেমনি হাঁটু দুমড়ে স্থির হয়ে বসে আছে। কর্নেল ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন—লতিফ খাঁ! লতিফ খাঁ! তার দুপাশে শংকর ও অজিতেশ এসে দাঁড়ালেন।