ইট ও টালিভাটাটা এখন পোড়ো হয়ে গেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় পুকুরের মতো গর্ত বা খাল আর ঢিবি রয়েছে। ঢিবিতে জঙ্গল গজিয়েছে। সতুবাবুরা একসময় রোডস ডিপার্টমেন্টের জন্য ইট ও টালি সাপ্লাই দিতে ওখানে ভাটা বানিয়েছিলেন। দুটো মস্তো চিমনি রয়ে গেছে।
হেকিমসায়েব ওখানে ঢুকল কেন? আর ওর ব্যাগে কী এমন ভারী জিনিস আছে যে অমন করে কুঁজো হয়ে পা ফেলছিল সে?
ন্যাড়ার মাথায় এই এক রোগ। তার খেয়াল চড়লে আর জ্ঞানগম্যি থাকে না। সে দৌড়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে দেখার চেষ্টা করল, হেকিমসায়েব যাচ্ছেটা কোথায়? কিন্তু ওদিকটা ঘন অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ হতাশভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ন্যাড়ার সম্বিৎ ফিরল। এদিকটা শীতটাও বেজায় বেড়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঠেকে কাঁপুনিতে অস্থির। ন্যাড়া ওখান থেকে মোড়ে ফিরে এল। তারপর প্রায় চোখ বুজে নির্জন রাস্তা দিয়ে দৌড় লাগাল।
এক দৌড়ে পরের মোড়ে এসে সে ডান দিকে ঘুরল। তারপর গলিরাস্তায়, আরেক দৌড়ে একেবারে বাড়ির দরজায় পৌঁছোল।
রোয়াকে উঠেই সে চেঁচিয়ে উঠল—মা! ওমা!
সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে তার মায়ের গলা ভেসে এল—কে রে?
ন্যাড়া ভয়েভয়ে বলল—আমি।
সুনন্দা দরজা খুলেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন—ওগো! ন্যাড়া এসেছে! ন্যাড়া! তারপর ছেলেকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
ভেতরে রমেনবাবু-ন্যাড়ার বাবা চুপচাপ বসেছিলেন। শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে গর্জে বললেন—ওরে হতভাগা! আয়, মজা দেখাচ্ছি তোর!
ন্যাড়া মায়ের বুকে মিশে আছে। নির্ঘাত বাবা একচোট চড়থাপ্পড় আগে মেরে বসবেন—ব্যাপারটা কত সাংঘাতিক তা বুঝতেই চাইবেন না হয়তো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রমেনবাবুরও চোখে জল। ধরা গলায় বললেন—অমন করে বাড়িপালানো অভ্যাস করলে তুই কি মানুষ হতে পারবি খোকা? দেখো দিকি কাণ্ড। আজ দুদিন ধরে বাড়িতে রান্নখাওয়া বন্ধ!
যাক্, বাবাও কেঁদে ফেলেছেন। ন্যাড়া নিশ্চিন্ত। বাড়িতে খুব সাড়া পড়ে গেছে। দিদি অমিতা ওর গালে চিমটি কেটে গরম জল করতে গেল। বাবা একটা গরম চাদরে ন্যাড়াকে জড়িয়ে ফেললেন। সুনন্দা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন বাড়িময়।
সেই হট্টগোলের সময় হঠাৎ কোত্থেকে শংকরবাবু হাজির।
বাড়ি ঢুকে ন্যাড়াকে দেখে তিনি কয়েকমুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
ন্যাড়া মিটিমিটি হাসছিল।
শংকরবাবুর মুখে কথা ফুটল অবশেষে। বলে ফেললেন—তোকে ওরা ছেড়ে দিল তাহলে? ন্যাড়া বলল—হুঁ, তাই বুঝি? আমি বুদ্ধি করে পালিয়ে এসেছি।
রমেনবাবু ও সুনন্দা অবাক হয়ে বললেন—অ্যাঁ! সে কী কথা!
শংকরবাবু বললেন—সব বলছি। সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ন্যাড়া যে প্রাণে বেঁচে পালিঃ আসতে পেরেছে, এজন্যে ওকে পুরস্কার দেওয়া দরকার।
রমেনবাবু বললেন—আহা! বলবে তো কী হয়েছিল?
শংকরবাবু জবাব দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ ন্যাড়া বলে উঠল—ছোটমামা! একটা কথা শোনো। আমি স্টেশন থেকে আসছি, তখন সতুবাবুদের ভাটার মধ্যে মুসলমানপাড়ার হেকিম লোকটা ভারী ঝোলা কাঁধে নিয়ে চুপিচুপি ঢুকে পড়ল। তারপর…
শংকরবাবু সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছিলেন। বললেন—জামাইবাবু! আমি একটু পরে আসছি। বলে সবাইকে অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর…
১৪. নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন
লিটনগঞ্জের বাজার এলাকা বাদে রাত নটা না বাজতে বাজতেই এই শীতে সবগুলো পাড়া নিশুতি নিঃঝুম হয়ে পড়ে। বাজারেও অবশ্যি খাঁ খাঁ অবস্থা। কিছু কিছু দোকান খোলা এবং লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে বাতি কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। এই নির্জন নিঃঝুম রাস্তায় পুলিশ সুপারের জিপ এগিয়ে চলেছে স্টেশনরোডের দিকে। একটু পেছনে চলেছে। একটা মস্তো পুলিশভ্যান। তাতে বসে রয়েছেন সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর কয়েকজন অফিসার।
জিপে আছেন পুলিশ সুপার অজিতেশ, কর্নেল আর শংকর।
শংকরের মুখে খবর পেয়েই এই অভিযান। সতুবালাদের পোড়ো ইটভাটার দিকে ঘুরপণে এগিয়ে চলেছেন ওঁরা।
জলের ট্যাংকের কাছে পৌঁছে কথামতো পুলিশভ্যান থামল। সশস্ত্র সেপাইরা আর অফিসাররা নিঃশব্দে ইটভাটার চারদিক ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলেন অন্ধকারে। ঝোপে জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে শিকারি বাঘের মতো ওরা পা বাড়ালেন।
জিপটা একটু তফাতে রেখে কলে, শংকর আর অজিতেশ দ্রুত এগিয়ে চললেন ভাটার দিকে।
বিশাল পোড়োভাটায় খানাখন্দ, ঢিবি, আর চিমনির কথা আগেই বলা হয়েছে। পুরো এলাকা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। তার ওপর কুয়াশা।
ভাটায় ঢোকার জন্য সরু একফালি পথ আছে। সে-পথে ইতিমধ্যে ঘাস ও জঙ্গল গজিয়েছে। কিন্তু পথটায় খোয়া বিছানো থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিছুটা এগিয়ে কর্নেল থমকে
দাঁড়ালেন।
ফিসফিস করে বললেন—এই ভাটার নিশ্চয় একটা অফিসঘর ছিল। সেটা কাছাকাছি থাকা উচিত।
অজিতেশ বললেন—হা। দিনে এখান দিয়ে যেতে চোখে পড়েছে বটে। মনে হচ্ছে সামনে ঢিবিমতো জায়গায় দরমার বেড়ার কয়েকটা ঘর আছে।
শংকর বললেন—টর্চ জ্বেলে দেখে নিলে হত।
কর্নেল বললেন—মাথা খারাপ? অন্ধকারেই এগুতে হবে। এ ব্যাপারে আমার অবশ্যি অসুবিধে হয় না। কেন না, বনেজঙ্গলে বহুবার রাতবিরেতে জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলতে যাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। তোমরা আমার পেছনে-পেছনে এস।
এসব কথা ফিসফিস করেই বলাবলি করছিলেন তিনজনে। খানিকটা এগিয়ে অন্ধকারে আবছা একটা উঁচু জায়গা নজরে এল। খোয়াবসানো পথটা সোজা সেখানে উঠে গেছে। হ্যাঁ, ওই তো ভাটার সেই অফিসগুলো সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।