কে, কে অজিতেশ?
শংকরবাবুর সেই বাজার সরকার। কারণ তার পকেটে তার নাম ঠিকানা লেখা একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেছে। ঠিকানায় কেয়ার অফ শংকরবাবুর নাম রয়েছে।
আমি যাচ্ছি! বলে কর্নেল ফোন রেখে দিলেন।
১২. গোরস্তানে অভিযান
তোপখানার এদিকটায় মুসলমানপাড়া। এলাকা জুড়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তুপ ছড়িয়ে রয়েছে। সেইসব ধ্বংসস্তুপে আগাছার জঙ্গলও গজিয়েছে। একপাশে মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা আর কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শীতের বেলা ফুরিয়ে গেছে। বাতি জ্বলেছে। সবে। কর্নেল ওই রাস্তায় ভিড় দেখতে পাচ্ছিলেন। একদল পুলিশ সেই ভিড় ঠেকিয়ে রেখেছে। পুলিশের জিপ, ভ্যান আর একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অজিতেশ কর্নেলকে দেখে এগিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন—লাশ কোথায়?
ওই যে, ওখানে পোডড়াবাড়ির মধ্যে।
বলে অজিতেশ কর্নেলকে নিয়ে রাস্তার পাশে আগাছার জঙ্গল ঠেলে ঢুকলেন। পোড়ো বাড়িটা আসলে কোনও একটা নবাবি অতিথিশালার একটা অংশ। ভেঙেচুরে একাকার। শুধু একটা ঘর কোনওক্রমে টিকে আছে। একটা হ্যাসাগ রাখা হয়েছে লাশের কাছে। লাশটা সেই ঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পিঠে কাধের কাছে একটা ছোরা তখনও বিঁধে রয়েছে। তাই বেশি রক্ত বেরুতে পারেনি।
হাসপাতালের ডাক্তারবাবু পুলিশ সুপারের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। ইশারা পেয়ে ছোরাটা টেনে বের করলেন। এক ঝলক জমাট রক্ত বেরিয়ে এল। কর্নেল মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
আরও সব পুলিশ অফিসার লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা ততক্ষণে মোটামুটি তদন্ত করে ফেলেছেন ঘটনাটার। কিন্তু কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম।
কর্নেল হেঁট হয়ে ঘরের মেঝে পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। বারান্দা থেকে উঠোনে টর্চের আলো ফেলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন। পুলিশ অফিসাররা তাই দেখে বাঁকা মুখে হেসে পরস্পর তাকাতাকি করছিলেন। এ বুড়ো আবার কে—বেমক্কা নাক গলাতে এসেছে এবং পুলিশ সুপার তাকে এত খাতির করছেন!
কর্নেল উঠোনের কোনা থেকে কী একটা কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন।
ওদিকে লাশ ধরাধরি করে হাসপাতালের লোকেরা অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। মর্গে নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেম করা হবে। ডাক্তারবাবুও চলে গেলেন।
অজিতেশ এতক্ষণে কর্নেলের কাছে এসে বললেন-কী বুঝলেন কর্নেল?
কর্নেল বললেন—আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মদনবাবু কারুর কথামতো সেই কালো বাকসোটা কলকাতা থেকে এনে এই পোড়ো বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন। আচমকা তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খুনি বাকসোটা নিয়ে ভেগেছে। ছোরাটা তুলে নেওয়ার সময় পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।
কেন সময় পায়নি, অনুমান করতে পারছেন?
সম্ভবত কেউ এসে পড়েছিল।
কোনও সূত্র খুঁজে পেলেন কি কর্নেল?
কিছু পেয়েছি বইকি। বলে কর্নেল একটু হাসলেন।
বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল বললেন—তোমায় বলতে আপত্তি কীসের? প্রথম সূত্র—ঘরের ভেতর ভাঙা কড়িকাঠ স্কুপের আড়ালে সুরকির গুঁড়োয় জুতোর ছাপ আছে দেখলুম। কেউ মদনবাবুর জন্যে আগে থেকেই ওখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। তবে সে ছোরা মারেনি। যে মেরেছে, সে বাইরে থেকে আচমকা ঢুকে মেরেছে এবং সম্ভবত এক-ঝটকায় মদনবাবুর ব্যাগটা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।
বলে কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো বাঁকাচোরা শেকড় বের করলেন।
অজিতেশ অবাক হয়ে বললেন—ওটা কী? কোথায় পেলেন?
উঠোনের কোনায়। খুনি পালাবার সময় এটা তার হাত থেকে পড়ে গেছে।
ওটা একটা শেকড় না?
হ্যাঁ শেকড়। আর এই দ্যাখো, এতে একটু রক্ত লেগে রয়েছে।
অজিতেশ অবাক হয়ে বলল—খুনির হাতে এই শেকড় ছিল? কেন?
কর্নেল একটু হেসে বলল—অজিতেশ! খুনি কে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তাকে সম্ভবত এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?
অজিতেশ ব্যস্তভাবে বললেন—দোহাই কর্নেল! দয়া করে আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন, কে সে? এখনই তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশবাহিনী পাঠাব।
কর্নেল আনমনে বললেন—আমারই বুদ্ধির ভুল! আঃ তখনই যদি…
কর্নেল! আবার হেঁয়ালি করছেন আপনি!
কর্নেল স্থিরদৃষ্টে পুলিশ সুপারের দিকে তাকিয়ে বললেন-অজিতেশ! জনা চার-পাঁচ বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ অফিসার নিয়ে তুমি এখনই আমার সঙ্গে এস। আমার ধারণা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?
অজিতেশ তক্ষুনি পুলিশ অফিসারদের ডেকে জিপে উঠতে বললেন। তারপর কর্নেলকে ডেকে বললেন—আমরা রেডি। চলে আসুন কর্নেল।
কর্নেল জিপের সামনে অজিতেশের পাশে বসে বললেন—সোজা আমার বাংলোয় চলো। ওখানে জিপ রেখে আমরা যথাস্থানে রওনা দেব।
জিপ প্রচণ্ড বেগে ছুটল। আলো আর ভিড়েভরা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে জিপ নদীর ধারে সরকারি বাংলোয় পৌঁছোল। কর্নেল বললেন—সবাই আমার সঙ্গে আসুন। কোনও শব্দ করবেন না টর্চ রেডি রাখুন। কেউ যেন গুলি ছুঁড়বেন না। সাবধান! যদি কেউ আক্রমণ করে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে কেউ আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না!
অজিতেশ ও পুলিশ অফিসাররা কর্নেলকে অনুসরণ করলেন।
কর্নেল অন্ধকারে নদীর দিকে হাঁটছিলেন। সেই গাবতলায় পৌঁছে একটু দাঁড়ালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন—নদীর ওপারে যেতে হবে আমাদের। দেখবেন, কেউ যেন জলে না
পড়েন।
কুয়াশার মধ্যে মিটমিটে নক্ষত্রের আলো নদীর জলে কোথাও কোথাও ঝিকমিক করছে। সাবধানে বালির চড়া পেরিয়ে সবাই ওপারে পৌঁছলেন।